চায়ের কাপে দুই চুমুক দিয়ে রেখে দিলে কী হবে? যে চা খাওয়া হয় নাই সেই চা কি সাপ হয়ে দংশন করবে? আতরজান বেঁচে থাকলে মাহফুজ জিজ্ঞেস করত। তিনি গত বৎসর ইন্তেকাল করেছেন। শয়তানের গল্প বলার মানুষটা আর নেই। না থাকলেও সুপুরি হেঁচার শব্দটা তিনি রেখে গেছেন। মাহফুজ বাঁশের চোঙ্গায় সুপুরি হেঁচার শব্দ প্রায়ই পায়। খট খট, খট খট– কে যেন সুপুরি ভেঁচছে। এই তো শব্দটা হচ্ছে। ঠিক মাহফুজের মাথার ভেতর থেকেই শব্দ আসছে। স্পষ্ট শব্দ। আশে পাশে কেউ থাকলে তারো শোনার কথা। খট খট, খট খট, খট খট।
চা খাওয়া যাচ্ছে না। পেটের ভেতর পাক দিতে শুরু করেছে। মাহফুজ ক্লান্ত গলায় বলল, নিবারণ একটা পান আনায়ে দাও, কাঁচা সুপারি। শরীরটা জুত লাগতেছে না।
জর্দা?
না, জর্দা না।
আফনের ইস্কুলের কি অবস্থা?
এই শীতে ইনশাল্লাহ্ বিল্ডিংয়ের কাজ ধরব। রাজমিস্ত্রী বলা আছে।
একবার গিয়া দেইখ্যা আসব।
আস, দেইখ্যা যাও। এখন একবার দেখ। চাইর বছর পরে আরেকবার দেখ। কিছুই চিনবা না। গ্রামের মধ্যে পাকা সড়ক।
পাকা সড়ক?
অবশ্যই পাকা সড়ক। পুলাপানের খেলার জন্যে শিশুপার্ক। গ্রামের চাইরদিক ঘেইরা লাগাইছি রাধাচূড়া আর কৃষ্ণচূড়া গাছ। এই গাছগুলা হইল গ্রামের সীমানা। চাইর বছর পর গাছে যখন ফুল ফুটব তখন মনে হইব লাল ফিতা দিয়া গ্রাম বন্ধন করা হয়েছে।
বাহ।
অসুখবিসুখ হলে কোনে চিন্তাই নাই। গ্রামের মধ্যেই চিকিৎসালয়। পাস করা ডাক্তার।
চাইর বৎসরের মইধ্যে এইসব হইব?
অবশ্যই।
কাঁচা সুপারির পান চলে এসেছে। পান মুখে দিয়ে মাহফুজ সিগারেট ধরাল। সিগারেটের ধোয়াটা ভাল লাগছে না, মাথা ঘুরাচ্ছে। জ্বর বোধ হয় এসেই পড়ল। না খেয়ে সিগারেটটা যদি ফেলে দেয় তাহলে কী হবে? রোজ হাশরে কি এই সিগারেট কাঁকড়া-বিছা হয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরবে?
মাহফুজ উঠে পড়ল। দাম দিতে গিয়ে এক বিপত্তি, নিবারণ দাম নেবে না। এই ঝামেলা নিবারণ সবসময় করে। মাহফুজ বিরক্ত হয়ে বলল, ব্যবসা করতে বসেছ। দানের অফিস তো খোল নাই।
নিবারণ হাসিমুখে বলল, সবের সাথে ব্যবসা করি না। আফনের সাথে ব্যবসা নাই। আচ্ছা দেন, হাফ দাম দেন।
মাহফুজ হাফ দাম দিয়ে ঘাটলার দিকে রওয়ানা হল। রোদ এমন তেজী যে চোখ জ্বালা করছে। মাহফুজ ঠিকমত পা ফেলতে পারছে না, এলোমেলো পা পড়ছে। জ্বর মনে হয় চেপে আসছে। দাদীজান মাথার ভেতর বসে ক্রমাগত পান ঘেঁচে যাচ্ছেন। বুড়ি ভাল যন্ত্রণা শুরু করেছে। আরো দুটা প্যারাসিটামল খেয়ে ফেললে হত। পানির পিপাসাও হচ্ছে। অথচ এই একটু আগেই পানি খেয়েছে।
কে, মাহফুজ না?
জ্বি।
কি হইছে তোমার এমন কইরা হাঁটছ কেন?
কিছু হয় নাই।
তোমার স্কুলের খবর কি?
ইনশাল্লাহ এই শীতে কাজ শুরু হবে।
ইটা কিননের আগে আমার সাথে যোগাযোগ করবা।
জ্বি আচ্ছা।
ইসকুল ঘরের জন্যে ইটা। একটা পাবলিক কাজ। কোন লাভ রাখব না। এক নম্বরী ইটা দিব তয় একটা কথা বাকি না। খরিদ করবা নগদ পয়সায়। এক নম্বুরী ইটা বাইশ শ হাজার।
জ্বি আচ্ছা।
তোমার কি শরীর খারাপ?
জ্বি না।
চউখতো দেখি লাল টুকটুকা।
দাড়িওয়ালা রোগা লোকটাকে মাহফুজ চিনতে পারছে না। লোকটা কে? বিড়ালের মতো চোখ। চোখে সুরমা। গা থেকে আতরের গন্ধ আসছে। লোকটা কথা বলছে পরিচিত ভঙ্গিতে। নিশ্চয়ই পরিচিত কেউ। মাহফুজ চিনতে পারছে না কারণ এই মুহূর্তে তার মাথার ভেতর দাদীজান বসে সুপুরি হেঁচছেন। মহিলা যখন এই কাণ্ডটা করেন তখন ঘোরের মতো লাগে।
মাহফুজ মনে মনে বলল, পান ছেঁচা বন্ধ কর দাদী। অনেক সুপারি খাইছ আর না।
আতরজান বললেন, কাজটা ভালো করস নাইরে আবু। কাজটা মন্দ করছস।
কোন কাজটা মন্দ করছি?
মেয়েটার নিয়া আসলি। খারাপ পাড়ার খারাপ মেয়ে।
কে বলছে খারাপ মেয়ে?
আমি জানি।
সে খারাপ হইলেও কিছু যায় আসে না। আমার তো তারে দরকার নাই। আমার দরকার তার কাজ।
তিন চাইরটা শয়তান তোর পিছে পিছে সব সময় ঘুরে। বড় সাবধান।
শয়তান ঘুরে কেন?
যে মন্দ তার পিছে কোনো শয়তান থাকে না। হে এমেই মন্দ। তার শয়তান দরকার নাই। যে যত ভালো তার পিছনে তত শয়তান। তোর সাথে আছে চাইরটা। খুব সাবধান।
দাদীজান, পান ছেঁচা বন্ধ করবা? অসহ্য!
যে চাইরটা শয়তান তোর পিছে পিছে ঘুরতাছে তার মধ্যে দুইটা নারী দুইটা পুরুষ। তুই একটা মিথ্যা কথা বলবি আর লগে লগে এরার বিবাহ হইব। শয়তান সংখ্যায় বাড়ব।
চুপ কর।
আমি তো চুপ কইরাই থাকতে চাই। তোর জন্যে মন কান্দে বইল্যা পারি না। তোর শইল দেখি বেজায় খারাপ।
হুঁ খারাপ। তুমি পান ছেঁচা বন্ধ কর।
মহিলা পান ছেঁচা বন্ধ করল না। প্রবল উৎসাহে বুড়ি পান ছেচছে। মাথার ভেতর শব্দ হচ্ছে খট খট, খট খট, খট খট।
.
নৌকা ছেড়েছে সকাল এগারোটায়।
এখন বাজছে বারোটা দশ। নৌকার ইনজিন থেকে বিকট শব্দ আসছে। ইনজিনের নৌকায় চিত্রা আরো চড়েছে, কখনো এত শব্দ হতে শুনে নি। শুধু শব্দ না, শব্দের সঙ্গে পেট্রোলের গন্ধ, ধোয়ার গন্ধ বিশ্রী অবস্থা। মাঝে মাঝে কুচকুচে কালো তেল জাতীয় কী যেন ইনজিন থেকে ছিটকে চারদিকে পড়ছে। ইনজিন চালাবার দায়িত্বে আছে নদশ বছর বয়েসী একটা ছেলে। ইনজিন থেকে তেল ছিটার ঘটনা যতবার ঘটছে ততবারই সে আনন্দে দাঁত বের করে দিচ্ছে। পর মুহূর্তেই গম্ভীর গলায় বলছে– ইনজিল গরম হইছে গো। নৌকার যে হাল ধরে আছে সে বলছে, বেশি গরম? ছেলেটা আগের চেয়েও গম্ভীর গলায় বলছে, মিডিয়াম গরম। তখন মাঝি চোখমুখ কুঁচকে ইনজিনকে কুৎসিত একটা গালি দিচ্ছে ইনজিনের মাকে সে কী করবে তা নিয়ে গালি। গালির অর্থ বুঝতে পারলে ইনজিনের খুবই রাগ করার কথা।