.
মাহফুজ ঘরের দিকে রওনা হল। মাথার যন্ত্রণা বাড়তে শুরু করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যই হুঁস জ্ঞান বলে কিছু থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। এটা খারাপ না। যার হুঁস জ্ঞান নাই তার দুঃশ্চিন্তা নাই। সবচে সুখি মানুষ হল মৃত মানুষ।
.
চিত্রা বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছিল। তার হাতে নাটকের বই। পাঠ তার মুখস্ত। তারপরেও চোখ বুলিয়ে যাওয়া। মফঃস্বলের নাটকে মেয়েদের রিহার্সেলের দরকার হয় না। নাটকের আগে তাদের স্টেজে তুলে দেয়া হয়। চিত্রা বই থেকে মুখ তুলে খুবই আশ্চর্য হল। মাহফুজ উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন নিজের বাড়িঘর চিনতে পারছে না। মাহফুজকে ভয়ংকর দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে টপটপ করে চোখ দিয়ে রক্ত। পড়বে। চিত্রা দেখে আঁৎকে উঠে বলল, আপনার কি হয়েছে? মাহফুজ চট করে জবাব দিতে পারল না। তাকিয়ে রইল। তার কেমন যেন ধাঁধার মত লাগছে। চিত্রা মেয়েটাকে এত সুন্দর লাগছে কেন? সকালেও তো এত সুন্দর লাগে নি। অবশ্যি এখন বিকাল। আকাশে সামান্য মেঘ আছে। মেঘলা বিকালে কন্যা সুন্দর আলো বের হয়। সেই আলো মনে হয় বের হয়েছে। সুলতান সাহেবের মেয়ে রানুর চেয়েও তাকে বেশি সুন্দর লাগছে। মনে হয় মেয়েটার শরীর এখন জ্বর নেই। সে গোসল করেছে। গোসলের পর পর যে কোন মেয়ের সৌন্দর্য দশগুণ বেড়ে যায়।
মাহফুজ থেমে থেমে বলল, তুমি কি গোসল করেছ?
চিত্রা বলল,আমি গোসল করেছি কি করি নাই তা দিয়ে আপনার দরকার কি?
জ্বর ছিল তো। জ্বর গায়ে গোসল করা ঠিক না এই জন্যে জিজ্ঞেস করেছি।
হ্যাঁ আমি গোসল করেছি। আপনার কি হয়েছে?
কিছু না।
মাহফুজের মাথা ঘুরছে। আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। সে উঠোনেই বসে পড়ল। চিত্রা এগিয়ে এসে মাহফুজের সামনে দাঁড়াল। মাহফুজের মনে হচ্ছে মেয়েটা যেন বাতাসে ভাসতে ভাসতে তার দিকে আসছে।
আপনার শরীর কি আবারও খারাপ করেছে?
হু।
প্রায়ই কি আপনার এরকম শরীর খারাপ করে?
কোন ঝামেলা হলে শরীর খারাপ করে।
কি ঝামেলা হয়েছে?
কোন ঝামেলা হয় নাই। একটু পানি খাব।
আপনি ঘরে এসে শুয়ে পড়ুন। আমি পানি এনে দিচ্ছি।
চিত্রা জ্বর দেখার জন্যে কপালে হাত দিতে গেল। মাহফুজ মাথা সরিয়ে নিল। চিত্রা কঠিন গলায় বলল, আমি গায়ে হাত দিয়ে জ্বর দেখলে কি কোন সমস্যা আছে।
মাহফুজ বিড়বিড় করে বলল, না।
তাহলে মাথা সরিয়ে নিলেন কেন? আমি খারাপ মেয়ে, শরীরে হাত লাগলে শরীর নোংরা হয়ে যাবে, এই জন্যে?
আরে ছিঃ এইসব কি বল?
তাহলে আপনি আমার হাত ধরুন। আপনাকে বিছানায় শুইয়ে দিব। মাথায় মনে হয় পানিও ঢালতে হবে।
মাহফুজ বিড়বিড় করে বলল, তোমাকে সুন্দর লাগছে।
চিত্রা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে। মানুষটা মনে হয় জ্বরের ঘোরে কথা বলা শুরু করেছে। জ্বর একবার মাথায় বসলে মাথার ভেতরের অনেক কথা আস্তে আস্তে বের হতে শুরু করে। চিত্রার মনে হয় এই লোকটার মাথার ভেতরে অনেক মজার মজার কথা আছে। কথাগুলো শুনতে নিশ্চয়ই ভাল লাগবে। তবে মাথার গভীরে বসে থাকা কথা শুনতে নেই। পাপ হয় তার নিজের মাথার ভেতরেও অনেক ভয়ংকর কথা আছে। সেই কথাগুলো অন্য কেউ শুনলে নিশ্চয়ই তার ভাল লাগবে না। সব মানুষেরই কিছু না কিছু ভয়ংকর কথা থাকে। কথা যত ভয়ংকর মাথার তত গভীরে তার বাস। রানুর মত ভাল মেয়েরও ভয়ংকর কথা কিছু না কিছু থাকবে। মওলানা ইস্কান্দার থাকবে। থাকতেই হবে…।
মাহফুজ বিড়বিড় করে বলল, দাদীজান একটু থামেন।
চিত্রা বলল, কি বলছেন?
মাহফুজ ক্ষীণ গলায় বলল, তোমাকে না। দাদীজানের সঙ্গে কথা বলি।
কোথায় আপনার দাদিজান?
মাহফুজ হতাশ ভঙ্গিতে চারদিকে দেখছে। চিত্রা শক্ত গলায় বলল, আর কথা না। এবার উঠুন। আপনাকে বিছানায় নিয়ে যাচ্ছি।
মাহফুজ বলল, তোমাকে খুবই সুন্দর লাগছে। অবেলায় গোসল করেছ তো। এই জন্যে। অবেলায় গোসল করলে মেয়েদের খুব সুন্দর লাগে।
চিত্রা বলল, গোসল না করলেও আমি সুন্দর। আর বিড়বিড় করতে হবে না। হাত ধরুন।
মাহফুজ হাত ধরল। হাত ধরে যে তাকে প্রায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে সে কে? তার পরিচিত কেউ? তার গা থেকে অদ্ভুত গন্ধও আসছে। জদার গন্ধের মত গন্ধ। ভাল লাগে, কিন্তু মাথা ধরে যায়। দাদীজানের মুখের পান থেকে কি এই জদার গন্ধ আসছে। পান হেঁচার খটাখট শব্দটা হচ্ছে না। তার অর্থ একটাই- বুড়ি পান খাওয়া শুরু করেছে।
দাদীজান তুমি আছ?
বুড়ি মাথা দুলাতে দুলাতে ছড়া কাটল,
লাউ এর ভিতরে বইয়া বুড়ি
ছেঁচা গুয়া খায়।
একখান ঠেলা দেওছান দেহি
কদ্দুর দূরা যায়।
বুড়ি ছড়া বলতে বলতে খিকখিক করে হাসছে। মাহফুজ ভেবে পেল না বুড়ির মনে এত আনন্দ কেন!
.
চিত্রার খুবই অদ্ভুত লাগছে। সম্পূর্ণ অচেনা একটা জায়গায় সে আছে, অচেনা একজন মানুষের মাথায় পানি ঢালছে অথচ ব্যাপারটা তার কাছে মোটেই অস্বাভাবিক লাগছে না।
মাহফুজের বাড়িটা মাটির। মাটির বাড়ি বলেই কি বেশি আপন লাগছে? ইটের দালান, টিন বাঁশের বেড়ার বাড়ি তো এত আপন লাগে না।
মানুষ মাটির তৈরি বলেই কি মাটির ঘর-বাড়ি এত আপন লাগে? চিত্রার মা বলতেন- মানুষের আসল ঘর মাটির-কব্বর।
চিত্রা তখন বলত, ওটা ঘর না মা, গর্ত। মাটির নিচে ঘর হয় সাপের আর ইঁদুরের। মানুষের ঘর হবে মাটির উপরে। মৃত্যুর পর মানুষ আর মানুষ থাকে না,তখন সে গর্তে ঢুকে যায়।