জ্বি, অবাক হয়েছি।
অবাক হওয়ার কিছু নাই। এই ধরনের মেয়েরা নাটকের বাইরেও এইভাবে কিছু বাড়তি রোজগার করে। এতে তারার নিজেদের সংসার ভাল চলে আর আমার মত দুষ্ট লোকরারও কিছু সুবিধা হয়।
মেয়েটা এ রকম না।
তোমার কাছে হয়ত না। তোমার কাছে এই মেয়ে ভাল ভাল কথা। বলেছে। আমার সাথে বলবে না। যাই হোক তুমি এত দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ো না। এই মেয়ের সঙ্গে কথাবার্তা যা বলার আমার লোকজন বলবে। তারপর যদি এই মেয়ে আমার সঙ্গে ময়মনসিং যেতে চায় আমার সঙ্গে যাবে। আর যদি যেতে না চায় থাকবে। জোর জবরদস্তির কোন ব্যাপার না। সবই হবে আপোষে। এতে কি তোমার অসুবিধা আছে।
জ্বি অসুবিধা আছে। আমি মেয়ের মাকে কথা দিয়ে এসেছি আমি নিজে তাকে পৌঁছে দিয়ে আসব।
তুমি তোমার কথা রাখার চেষ্টা কর। তুমি তোমার কাজ করার চেষ্টা করবে। আমি আমার কাজ করার চেষ্টা করব।
মাহফুজের মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। পান ঘেঁছার মত শব্দ হচ্ছে। খটখট খটখট খটাখট। খটখট খটখট খটাখট। দাদীজান শুধু যে পান খাচ্ছেন তাই না, মনে হচ্ছে মুচকি মুচকি হাসছেনও। এখন মনে হচ্ছে। কথাও বললেন– আবু ও আবু কি হইছে?
দাদীজান চুপ করেন। আমি বিপদের মইধ্যে আছি।
তোরে বলছিলাম না। মেয়েটারে নিয়া আইস্যা ভাল করস নাই। বলছিলাম, কি বলি নাই?
হ্যাঁ বলছিলেন।
এখন দেখতেছস কত বড় বিপদ?
হু।
বৃদ্ধা পান ঘেঁছে যাচ্ছেন। খটাখট খটখট শব্দ হচ্ছে। মাহফুজের মাথায় যন্ত্রণা ক্রমেই বাড়ছে।
ছদরুল বেপারী বললেন, তোমার কি শরীর খারাপ করেছে?
মাহফুজ কিছু বলল না। ছদরুল বেপারী নিচু গলায় বললেন, তোমার চোখ টকটকা লাল।
আমার মাথায় যন্ত্রণা।
বেশি?
হ্যাঁ বেশি।
আমার কথাবার্তা শুনে কি মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়েছে?
জ্বি।
তাহলে আমি খুবই শরমিন্দা। যাই হোক, তুমি টাকাটা নাও। নিয়ে। চলে যাও।
মাহফুজ বড় করে নিশ্বাস ফেলে বলল, আপনার টাকা আমি নিব না। ছদরুল বেপারী মাহফুজের কথায় চমকালেন না, বা বিস্মিতও হলেন না। মনে হয় তিনি ধরেই নিয়েছিলেন মাহফুজ এই ধরনের কথা বলবে। কিংবা তিনি যে কোন ধরনের কথা শুনে অভ্যস্ত।
তুমি আমার টাকা নিবে না?
জ্বি না।
কেন? আমি দুষ্ট লোক বলে? আমি যে দুষ্ট এটাতো তুমি আগেই জানতে। জানার পরেও তো টাকার জন্য গিয়েছ। যাও নাই?
মাহফুজ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
ছদরুল বেপারী সহজ গলায় বললেন, মানুষ মন্দ হয়। মানুষের টাকা মন্দ হয় না। টাকার গায়ে ভাল মন্দ লেখা থাকে না। ভাল মানুষের টাকা দিয়েও যেমন অতি মন্দ কাজ করা যায়, মন্দ মানুষের টাকা দিয়েও অতি ভাল কাজ করা যায়। এই দেশের বেশির ভাগ স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা কারা করেছেন? পয়সাওয়ালা লোকেরা করেছেন। যাদের প্রচুর টাকা পয়সা থাকে তারা সেই টাকা পয়সা কিভাবে জোগাড় করে? নানান ফন্দি ফিকির করে জোগাড় করে। ধান্ধাবাজি করে জোগাড় করে, কালোবাজারি করে জোগাড় করে। অতি সৎ যে মানুষ তার ঘরে টাকা জমে না। বুঝেছ? সৎ মানুষের ডাল থাকে তো নুন থাকে না।
জ্বি বুঝেছি।
কাজেই ধরে নিতে পারি এই দেশের বেশির ভাগ সৎ কর্ম করা হয়েছে– নষ্ট মানুষের দানে। যুক্তি কি তুমি মান?
মানি।
এখন তাহলে আমার টাকা নিতে তোমার অসুবিধা নাই।
আমার অসুবিধা আছে। আমি আপনার টাকা নিব না।
মাথার ভেতর খটখট শব্দটা বাড়ছে। বুড়ি বড় যন্ত্রণা করছে। বুড়ি আবার কথা বলা শুরু না করলেই হয়।
মাহফুজ উঠে দাঁড়াল।
ছদরুল বেপারী বললেন, চলে যাচ্ছ না-কি?
মাহফুজ বলল, জ্বি।
আচ্ছা ভাল। সৎ কাজ সৎ অর্থে করাই ভাল। তোমার চোখ যে রকম লাল হয়েছে, তোমাকে দেখে ভয় লাগছে। বাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম কর।
ছদরুল বেপারী একজনকে সোনার মেডেল কিনতে পাঠিয়ে দিল। তার এখন ঘুম ঘুম পাচ্ছে। ক্লাব ঘরে খাট পাতা আছে। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেয়া যায়।
মাহফুজ ক্লাবঘর থেকে বের হল। সে ঠিকমত পা ফেলতে পারছে না। সব কেমন এলোমেলো লাগছে। লক্ষণ ভাল না। তার শরীর এখন অতি দ্রুত খারাপ করবে। চোখ হবে পাকা করমচার মত লাল। সে রোদের দিকে তাকাতে পারবে না। তার দাদীজান মাথার ভিতরে এসে পান হেঁচতে হেঁচতে কথা বলা শুরু করবে। বুড়ো-বুড়ি এমিতেই কথা বলে। মৃত্যুর পর বুড়ির কথা বলা খুব বেড়েছে। বুড়ির সব কিছুতেই নাক গলাতে হবে। সব। বিষয়ে কথা বলতে হবে। বুড়ির কোন কথা এখন শোনার দরকার নেই। বুড়ি উল্টাপাল্টা কথা বলতে থাকুক। সে শুধু শুনে যাবে। জবাব দেবে না।
বুড়ির মাথার ভেতর ডেকে উঠল, আবু। ও আবু?
মাহফুজ জবাব দিল না। বুড়ি তাতে দমবার পাত্রী না। সে ডেকেই যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে মাহফুজ এক সময় বলল, কি চাও?
বুড়ি বলল, আমি কিছু চাই না। তুই ভয় পাইছস?
ভয় পাব কি জন্যে?
ছদরুল বেপারীর সাথে বিবাদ করছস ভয় তো পাওনেরই কথা। হে তরে চাইটা খাইয়া ফেলব। হে হইল চাইট্টা খাউড়া।
চুপ কর।
তরে একটা বুদ্ধি দেই।
কি বুদ্ধি?
বুড়ির বুদ্ধি তুই শুনবি?
না।
তাইলে আর বুদ্ধি দিয়া লাভ কি?
কোন লাভ নাই। তুমি তোমার পান খাও।
আইচ্ছা।
বুড়ি পান ঘেঁছা শুরু করল। খটখট খটখট। খটাখট খটাখট। এরচে বুড়ির কথা শোনা ভাল ছিল। বাঁশের চোঙে পান ঘেঁছার শব্দ অসহ্য লাগছে। সেই বাঁশও ফাটা বাঁশ। এক সঙ্গে দুই তিন রকম শব্দ হচ্ছে।