দোষ কাটার জন্যে তো বলি না। বলতে ভাল লাগে এই জন্যে বলি। মানুষের এই এক বিচিত্র স্বভাব। যে ভাল কাজ করে সে ভাল কাজের কথা বলে আনন্দ পায়। যে মন্দ কাজ করে সে মন্দ কাজের কথা বলে আনন্দ পায়। আপনার এখানে পান আছে মওলানা সাহেব?
জ্বি না, পান নাই।
পান খাইতে ইচ্ছা করতেছে।
আপনে বসেন আমি নিয়া আসি।
দরকার নাই। তারচে বরং গল্পগুজব করি। আপনার চরিত্রে খারাপ কি আছে বলেন তো শুনি। ভাল মানুষ অন্য মানুষের চরিত্রে ভাল কি আছে। শুনতে চায়। খারাপ মানুষ চায় অন্যের খারাপটা শুনতে।
নিজের খারাপ জিনিসটাতো নিজের বলা মুশকিল।
মুশকিল হবে কেন? আপনার খারাপটাতে সবচে ভাল আপনি জানবেন। আমারটা যেমন আমি জানি। আমার খারাপ কি বলব?
দরকার নাই জনাব।
দরকার অদরকার কিছু নাই। শুনেন বলি, বলতে ইচ্ছা করতেছে। আমার সবচে বড় দোষ হল আপনার মেয়ে মানুষের দোষ। কোন মেয়ে মানুষ একবার যদি চোখে লেগে যায় তাহলে সর্বনাশ।
মওলানা তাকিয়ে আছেন। কি আশ্চর্য মানুষ কত সহজেই না কত ভয়ংকর কথা বলছে। যে মানুষ সহজে ভয়ংকর কথা বলে সে সহজে ভয়ংকর কাজও করে।
ছদরুল বেপারী গলা নিচু করে বললেন মেয়ে মানুষের দোষ কাটার কোন তাবিজ কি আছে?
মওলানা ইস্কান্দার বললেন, আমি তাবিজের বিষয়ে কিছু জানি না।
না জানলে কি আর করা?
ছদরুল বেপারী উঠে দাঁড়ালেন। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে দুটা পাঁচশ টাকার নোট এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, টাকাটা রাখেন মওলানা সাহেব। সামান্য উপহার।
চকচকে নতুন নোট। ইস্কান্দর আলির ইচ্ছা করছে বলেন, জনাব আমি আপনার টাকা নিব না। মন্দ মানুষের উপহার গ্রহণ করা নিষেধ আছে। ইস্কান্দর আলি তা বলতে পারলেন না। হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিলেন। টাকাটার দরকার। হাত একেবারে খালি। শীত আসছে এই অঞ্চল শীত বেশি পড়ে। লেপ কেনা দরকার। ভাল কাঁপাসি তুলার একটা লেপের দাম তিনশ টাকা। মশারিও কেনা দরকার। তাঁর মশারিটা ইঁদুর খেয়ে ফেলেছে। বড় ইঁদুরের উপদ্রব। ইঁদুর মারা একটা কল কিনতে হবে।
ছদরুল বেপারী সামান্য হাসলেন। হাসতে হাসতেই বললেন, শুরুতে বলেছিলাম না আপনার উপদেশ চাইতে এসেছি। এটা ঠিক না। আমি কারো উপদেশে চলি না। আবার কারো দোয়ার ধারও ধারি না। আপনার সম্পর্কে নানান কথা শুনি, আপনাকে দেখার ইচ্ছা ছিল। দেখা হয়েছে এতেই আমি খুশি।
ভরপেট খাওয়ার পর ছদরুল বেপারীর শরীর সব সময় হাঁসফাঁস করে, নিশ্বাসেও সামান্য কষ্ট হয়। আর সে রকম কিছু হচ্ছে না। শরীর ঝরঝরে লাগছে। একটা পান খাওয়া দরকার। কাঁচা সুপারি সঙ্গে কড়া জদা। ডাবল একসান। এই গ্রামে চা পান সিগারেটের দোকান এখনো চোখ পড়ছে না। আছে নিশ্চয়ই এখনকার গ্রাম আর আগের মত না। পান ফুরিয়ে গেল তো গালে হাত দিয়ে অপেক্ষা কর হাটবারের জন্য। বুধবার হাট। বুধবারের আগে পান পাওয়া যাবে না। সে গ্রাম আর নেই।
ছদরুল বেপারী মওলানার ঘর থেকে বের হতেই তার সঙ্গের লোকজনদের দেখা পেল। তারা আশেপাশেই ঘাপটি মেরে ছিল। তাদের দায়িত্ব ছদরুল বেপারীকে ছায়ার মত অনুসরণ করা, তারা সেই দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে। তাদের একজনের সঙ্গে পিস্তল আছে। চোরাই পিস্তল না। লাইসেন্স করা পিস্তল। পিস্তলের দাম সাত হাজার টাকা আর লাইসেন্স বের করার ঘুষের দাম এক লাখ দশ হাজার। অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া বের হওয়া ছদরুল বেপারীর মত মানুষের সমস্যা হয়ে গেছে। চারিদিকে শুক্র। আগে শত্রু মিত্র চেনা যেত এখন তাও যায় না। মিত্র ভাবে যে খুব কাছে আসে দেখা যায় সে মহা শত্রু।
গত চার বছরে দুবার ছদরুল বেপারীকে খুন করার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রথম বার তো মেরেই ফেলেছিল। বর্শা পেটে ঢুকিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছিল। সেই আঘাত সামলানো গেছে। দ্বিতীয়বারে অবশ্যি প্রথমবারের মত ভয়ংকার হয় নি। তবে হতে পারতো। এখন ছদরুল বেপারী অনেক সাবধান। তবে সাবধান হয়েও লাভ নেই। কপালে যা থাকবে তাই হবে। বেহুলার মত সাবধান স্ত্রীর স্বামীকেও সাপের কামড় খেতে হয়েছে। লোহার ঘর বানিয়েও রক্ষা হয়নি। তারপরও যতটুকু পারা যায় সাবধান থাকা।
ছদরুল বেপারী একজনকে কাঁচা সুপারি জদা দিয়ে পান আনতে পাঠালেন। সেই সঙ্গে বলে দিলেন মাহফুজকে খবর দিতে। মাহফুজের সঙ্গে জরুরি আলাপগুলো সেরে ফেলা দরকার। আলাপটা ক্লাবঘরে হবে। ক্লাবঘরের উঠানে না হয়ে ঘরের ভেতর হবে। উঠকো মানুষ যেন না থাকে। যদিও জরুরি সব আলাপ অনেক মানুষের সামনে হওয়া দরকার। যাতে সাক্ষী থাকে। ছদরুল বেপারী ক্লাবঘরের দিকে রওনা হলেন। মাহফুজের সঙ্গে কথা বলবেন, ভাঙ্গা মসজিদটা দেখবেন। নতুন একটা মসজিদ এই গ্রামে করে দেয়া যায়। মসজিদ বানিয়ে দেয়ার কথা কেউ এখনো তাকে বলে নি। না চাইতে তিনি কিছু দেন না। তার কাছে চাইতে হবে। বিকেলে যাবেন সুলতান সাহেবের সঙ্গে কথা বলার জন্যে। তারপর সন্ধ্যায় টিপু সুলতান নাটক- ভুজঙ্গ বাবুর অনেক নাম ডাক। তার নাটক আগে দেখা হয় নি। এইবার দেখা যাবে। তিনি সোনার একটা মেডেল স্যাকরার দোকান থেকে নিয়ে এসেছেন। যার অভিনয় ভাল হবে তাকে দেবেন। মেডেল ভুজঙ্গ পাবে এটাতো বলা বাহুল্য। আরেকটা মেডেল থাকলে ভাল হত। মেয়েটাকে দেয়া যেত। নাটকের মাঝখানে সোনার মেডেল ডিক্লেয়ার করা আনন্দময় ঘটনা। চারদিকে হৈ চৈ পড়ে যায়। নাটক যারা করে তাদের চেয়ে মেডেল যে দিচ্ছে সে হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। ছদরুল বেপারী ঠিক করলেন আরেকটা মেডেল কিনতে কাউকে পাঠাবেন। মেডেল যে দিতেই হবে এমন কোন কথা নেই, হাতে থাকল। এমনওতো হতে পারে তিনি নাটক দেখতেই গেলেন না। মানুষেরা সিদ্ধান্ত অতি দ্রুত বদলায়। জোয়ার ভাটা হয় নির্দিষ্ট সময়ে। মানুষের জোয়ার ভাটার কোন সময় নেই। নিয়মও নেই। এই জোয়ার এই ভাটা। আবার উল্টোটাও হয়–এই জোয়ার, এই আবার জোয়ার। তারপর আবারও জোয়ার। ভাটার দেখা নেই।