বেছে বেছে আজকের দিনেই রোজা ভাঙ্গলেন। আজ আমি ঠিক করেছিলাম আপনাকে ইফতারী করাব।
অন্য আরেকদিন ইফতার করব জনাব।
আপনি কি আমাকে চিনেন? আমি ছদরুল বেপারী।
মওলানা লজ্জিত গলায় বললেন, জনাব আমি আপনার নাম শুনি নাই।
এটা খুবই আশ্চর্যের কথা যে আপনি আমার নাম শুনেন নাই। যাই হোক কি আর করা। কি রান্না করেছেন?
দরিদ্র মানুষের দরিদ্র আয়োজন জনাব। ডাল ভাত।
আমি যদি আপনার সঙ্গে খাই আপনার কি খাবারে কম পড়বে?
জ্বি না জনাব। আল্লাহপাক যদি আমার এখানে আপনার রিজিক রাখেন তাহলে কম পড়বে না। আসুন খেতে বসি।
ভয় নেই আমি খুব সামান্য খাব। ইদানীং হজমের সমস্যা হয়েছে কিছুই হজম করতে পারি না। জাউ ভাত খেলেও টক ঢেকুর উঠে।
ছদরুল বেপারীর সঙ্গের লোকজন ইস্কান্দর আলির বাড়ির উঠোনে ঘুর ঘুর করছিল। ছদরুল বেপারী হাত ইশারায় তাদের চলে যেতে বললেন।
গরম ভাতের উপর ঘি দিতে দিতে ইস্কান্দর আলি বললেন, অতি দরিদ্র আয়োজন, নিজ গুণে ক্ষমা করবেন।
ছদরুল বেপারী কিছু বললেন না। তীক্ষ্ণ চোখে খাবারের ব্যবস্থা দেখতে লাগলেন। তাঁকে সামান্য চিন্তিত মনে হল।
এই মেঘ, রৌদ্রছায়া– পাতে ঘি দিয়েছেন? ঘি খাওয়া আমার জন্যে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আল্লাহপাকের নাম নিয়ে খান আল্লাহ পাকের নাম নিয়ে খেলে ইনশাআল্লাহ কিছু হবে না।
এটাতো মওলানা ঠিক বললেন না, যা নিষিদ্ধ তা সব সময়ই নিষিদ্ধ। খুন নিষিদ্ধ। আল্লাহপাকের নাম নিয়ে খুন করলেও সেই খুন সিদ্ধ হবে না। যাই হোক বিসমিল্লাহ বলে আমি খাচ্ছি। এত নিষেধ মানলে চলে না।
হাত ধুবেন না জনাব? হাত ধোয়ার পানি দিয়েছি।
হাত ধোয়ার দরকার নাই।
ছদরুল বেপারী খাবার উদ্দেশ্যে বসলেন না। হঠাৎ খেতে চাইলে একজন মানুষ কি করে সেটা দেখাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। কি মনে করে খাওয়া শুরু করলেন।
ছদরুল বেপারী এত আরাম করে দীর্ঘদিন খান নি। খাবার এমন স্বাদ হয় তা তিনি মনে হয় ভুলেই গিয়েছিলেন।
মওলানা সাহেব আপনার রান্নার হাত চমৎকার। খুবই আরাম করে খেয়েছি। খুবই তৃপ্তি পেয়েছি। সাধারণ খাবারে এত স্বাদ থাকে ভুলেই গিয়েছিলাম।
ইস্কান্দর আলি বললেন খাওয়া খাদ্যে স্বাদ দেবার মালিক আল্লাহপাক। স্বাদ উঠায়ে নেওয়ার মালিকও আল্লাহপাক।
ছদরুল বেপারী বললেন, আমি শুনেছিলাম মৃত্যুর আগে আগে খাওয়ার স্বাদ চলে যায়। এটা কি সত্যি?
এই বিষয় আমি কিছু জানি না জনাব।
আমি খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম। যা খাই কোনকিছুতে স্বাদ পাই না। আমি ধরেই নিয়েছিলাম আমার মৃত্যুর বেশি দেরি নেই। আজ মনে হচ্ছে মৃত্যুর দেরি আছে। খাওয়ার স্বাদ ফিরে এসেছে।
হায়ত-মউতের মালিক আল্লাহপাক। মানুষ এই বিষয়ে কিছুই জানে না। নবী-এ করিমের একমাত্র পুত্র কাশেম যে শৈশবেই মারা যাবে এটা নবী-এ করীম সাল্লালাহ আলাইহিস সালাম জানতেন না। অথচ তিনি ছিলেন আল্লাহপাকের পেয়ারা দোস্ত।
ছদরুল বেপারী সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, আপনার সম্পর্কে অনেক কথাবার্তা শুনেছি। কথা যা শুনেছি তা বোধ হয় সত্য না। মানুষ তিলকে তাল বলতে পছন্দ করে। নেংড়া বিড়াল দেখে এলে চোখ বড় বড় করে বলে, নেংড়া বাঘ দেখে এসেছি। তারপরেও আমার ধারণা আপনি সুখি মানুষ। আপনার কাছে কিছু উপদেশ চাই, উপদেশ দিন।
উপদেশ দেওয়ার মত যোগ্যতা আমার নাই জনাব।
যোগ্যতা আছে কি নাই সেটা আমি বিবেচনা করব। আপনাকে পরামর্শ দিতে বললাম আপনি পরামর্শ দিবেন। তার আগে জেনে রাখুন আমি খুবই দুষ্ট প্রকৃতির লোক। শয়তানের সঙ্গে আমার একটাই অমিল শয়তান অন্যদের খারাপ করার চেষ্টা করে আমি চেষ্টা করি না। নিজে খারাপ কাজ করি। এতেই আমি খুশি। অন্যকে খারাপ বানায়ে খুশি হবার প্রয়োজন আমার নাই। বুঝতে পারছেন কি বলছি?
ইস্কান্দর আলি হ্যাঁ না কিছুই বললেন না। তার সামনে বসে থাকা লোকটি যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তা তিনি বুঝতে পারছেন। অতি গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের কথা বলার একটা বিশেষ ভঙ্গি আছে। এই ভঙ্গি সে আয়ত্ব করে না। আপনাতেই তার মধ্যে চলে আসে।
ইস্কান্দর আলির ধারণা তার নিজের মধ্যে এই ভঙ্গি চলে এসেছে। তার নিজের কথা বলার ভঙ্গি এখন তাঁর কাছেই অপরিচিত লাগে। কথা বলার সময় মনে হয় সে কথা বলছে না অন্য কথা বলছে।
মওলানা সাহেব?
জ্বি।
আমি অতি দুষ্ট একজন মানুষ। এটা আমি বিনয় করে বলছি না। বিনয় আমার মধ্যে নাই। অবশ্য আমার মধ্যে অহংকারও নাই। আমি যা, আমি তা। এ নিয়ে বিনয় করারও কিছু নাই, অহংকার করারও কিছু নাই। আমি কি ঠিক বলেছি মওলানা সাহেব?
বুঝতে পারছি না জনাব। আমার জ্ঞান বুদ্ধি অত্যন্ত কম। যে যা বলে আমার কাছে মনে হয় সেটাই সত্যি।
ছদরুল বেপারী আগের সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে নতুন সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন– আপনি লোকটা হয় অতি চালাক নয় অতি বোকা। কোনটা এখনো ধরতে পারছি না। তবে ধরতে পারব।
জনাব, আপনি মানুষটা কেমন?
আমি বোকা। তবে শয়তানি চালাকি আমার আছে। শুধু আছে বললে কম বলা হয়- অনেক বেশি আছে। আমি আবার নিজের যা মন্দ তা বলে ফেলি। পেটে কিছু রাখি না। আমার হজমের গণ্ডগোল আছে এইজন্যই পেটে কিছু রাখতে পারি না। কথা হজম হয় না বলে বমি করে ফেলি। হা হা হা।
ইস্কান্দর আলি নিচু গলায় বললেন, নিজের মন্দটা বললে দোষ কাটা যায় না। যা মন্দ, বলে বেড়ালেও মন্দ। না বলে বেড়ালেও মন্দ।