রানু বলল, চিত্রাকে যে তুমি বিদেয় করেছ এ ব্যাপারে আমি এখন পুরোপুরি নিশ্চিত।
কিভাবে নিশ্চিত হলি?
মাহফুজ সাহেবের সঙ্গে আমি অনেকক্ষণ গল্প করেছি। তাকে বলেছি চিত্রা অসুস্থ। তিনি বলেছেন বিশ্রাম নিক। সন্ধেবেলা নাটকের আগে গেলেই হবে। আর তারপরই তোমার সঙ্গে উনার কথা হল। সুলতান সাহেব তখন বলতে শুরু করলেন ভুজঙ্গ বাবুর সঙ্গে রিহার্সেল। এতক্ষণ ভুজঙ্গ বাবু ছিলেন না। তোমার সঙ্গে কথা বলার পরই ভুজঙ্গ বাবু উদয় হলেন। বাবা তুমি কি সুলতান সাহেবকে বল নি চিত্রা মেয়েটিকে নিয়ে চলে যেতে।
বলেছি। কেন বলেছি জানতে চাস?
না, আমি জানতে চাই না। জানতে চাইলেই তুমি দশ বারোটা সুন্দর যুক্তি দেখাবে। যুক্তিগুলো খুবই গ্রহণযোগ্য মনে হবে। আমি যুক্তি শুনতে যাচ্ছি না। শুধু যুক্তি কেন আমি তোমার কোন কথাই শুনতে চাচ্ছি না।
আমার কোন কথাই শুনতে চাচ্ছিস না।
না। কারণ তুমি একজন ভান সর্বস্ব মানুষ। আমি ভান পছন্দ করি।
আমি ভান সর্বস্ব মানুষ?
অবশ্যই। তুমি কখনো লুঙ্গি পর না। তুমি অনেকবার বলেছ লুঙ্গি হচ্ছে একটা নোংরা এবং অশালীন পোষাক, অথচ তুমি যখনই গ্রামে আস তখনি লুঙ্গি নিয়ে আস। এবং গ্রামের পথে লুঙ্গি পরে ঘুরে বেড়াও। কারণ গ্রামের লোকজন এই ব্যাপারটা দেখে বলবে- আহা মানুষটা কত সহজ সরল।
রানু তুই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিস। এরকম উত্তেজিত হবার মত কোন ঘটনা ঘটে নি।
আমি তোমার মত না বাবা। আমি সাধারণ মানুষের মত। উত্তেজিত হবার মত কোন ঘটনা দেখলে আমি উত্তেজিত হই। তুমি কখন হও না। তোমার মাথা সব সময় ঠাণ্ডা। পনের বছর আগে তুমি খুব ঠাণ্ডা মাথায় আমার মাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পেরেছিলে। আমার তখন বয়স কত? দুবছর। আমাকে মার সঙ্গে যেতে দাও নি। আমার দেখাশোনার জন্যে আরেকটি বিয়ে তুমি করেছ। সেটিও করেছ খুব ঠাণ্ডা মাথায়।
Young lady compose yourself.
Thanks. I will try.
সুলতান সাহেব সিঁড়ি বেয়ে আবারও উঠে গেলেন। রানু একা একা পাখি খুঁজতে লাগল। পাখিটা বাগানেই কোথাও আছে। লুকিয়ে আছে পাতার আড়ালে। রানুর ধারণা এক্ষুণি পাখিটাকে পাওয়া যাবে।
.
চিত্রা কেমন এলোমেলো পা ফেলছে। মাহফুজ চিন্তিত বোধ করছে। সুলতান সাহেবের বাড়ি থেকে তার বাড়ি অনেকখানি পথ। মেয়েটার জ্বর যদি খুব বেশি হয় তাহলে সে এতখানি পথ হেঁটে যেতে পারবে না। কপালে হাত দিয়ে কি দেখবে জ্বর কত? এটা কি ঠিক হবে? না, ঠিক হবে না।
চিত্রা বলল, ভুজঙ্গ বাবু কখন এসেছেন?
মাহফুজ বলল, উনি এখনো আসেন নি। তার অ্যাসিসটেন্ট চলে এসেছে।
আপনি যে বললেন, ভুজঙ্গ বাবু এসেছেন। রিহার্সেল করবেন।
মিথ্যা কথা বলেছি। তোমাকে নিয়ে আসার জন্য বলেছি।
কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?
আমার বাড়িতে।
ঐ বাড়িতেই তো আমি খুব ভাল ছিলাম।
মাহফুজ নিচু গলায় বলল, আমার বাড়িতেও খুব ভাল থাকবে। চাদর গায়ে গিয়ে শুয়ে থাকবে। বিশ্রাম হবে। শরীর খারাপ করেছে এখন বিশ্রাম দরকার। ভাল বিশ্রাম না হলে রাতে নাটক টানতে পারবে না।
চিত্রা হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে গেল। কঠিন গলায় বলল, ঐ বাড়ি থেকে কি আমাকে বের করে দিয়েছে? সুলতান সাহেব নামের মানুষটা কি বলেছে আমাকে এক্ষুণি বিদেয় করে দিতে হবে।
মাহফুজ বলল, আরে না। কি বল তুমি। সুলতান সাহেব এরকম মানুষই না। তুমি অসুস্থ শুনে খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। আমাকে বললেন- এক্ষুণি ডাক্তার জোগাড় করতে। আমার মাথায় একশ ঝামেলা, এর মধ্যে কোথায় ডাক্তার পাব তুমিই বল।
চিত্রার চোখমুখ কঠিন হয়ে গিয়েছিল মাহফুজের কথায় আবার স্বাভাবিক হল। সে হাঁটতে শুরু করল। তবে মেয়েটার শরীর মনে হয় বেশ খারাপ। মনে হচ্ছে হাঁটতেই পারছে না।
মাহফুজ বলল, তুমি দেখি খুবই আশ্চর্য মেয়ে। তুমি ভেবে বসলে তোমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। হা হা হা।
চিত্রা গম্ভীর গলায় বলল, এ রকম হা হা করবেন না। বাড়ি থেকে বের করে দেবার ঘটনা আমার জীবনে আগে ঘটেছে বলেই আমি বলেছি। একবার রাত দুটার সময় আমাকে বের করে দিল। রাত একটার সময় নাটক শেষ হয়েছে। আমি ঘরে গিয়ে মেকাপ তুলছি তখন যে বাড়িতে আমার থাকার জায়গা সেই বাড়ির একজন বুড়ো মানুষ এসে খুবই খারাপ ভাষায় আমাকে বের হয়ে যেতে বললেন। যারা আমাকে সেই বাড়িতে তুলেছিল তারাও কেউ নেই। আমাকে রেখে চলে গেছে। কি যে বিপদে পড়লাম।
সুলতান সাহেব সেরকম না। ইনি অন্য ধরনের মানুষ।
চিত্রা ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলে বলল, তিনি যে অন্য রকম মানুষ তা তাঁর মেয়েটাকে দেখেই বোঝা যায়। মেয়েটা কি আশ্চর্য রূপবতী। মনে হয় তুলি দিয়ে আঁকা।
.
মাহফুজের বাড়িতে যেতে হলে ক্লাবঘরের সামনে দিয়ে যেতে হয়। ক্লাবঘরের সামনে বেশ ভিড়। কাঠের সবকটা চেয়ার রোদে পাতা হয়েছে। একটা বেঞ্চও বের করা হয়েছে। হাতলওয়ালা চেয়ারটায় ছদরুল ব্যাপারী বসে আছেন। ছদরুল ব্যাপারী কখনো একা ঘুরাফেরা করেন না। সঙ্গে চার পাঁচজন লোক থাকে। এখনো আছে। গ্রামের লোকজন তাদের ঘিরে আছে। ছদরুল ব্যাপারী মাহফুজকে দেখে হাত ইশারায় ডাকল। মাহফুজ অবাক হয়ে এগিয়ে গেল। ছদরুল ব্যাপারী এখন আসার কথা না। তার আসার কথা সন্ধ্যার আগে আগে। তিনি মওলানা ইস্কান্দার আলির জন্যে ইফতার নিয়ে আসবেন। ইস্কান্দার আলিকে ইফতার খাইয়ে নাটক দেখে চলে যাবেন। কি মনে করে সকালে এসেছেন কে জানে।