রানু বলল, তুমি চাও না আমি সেই কথাগুলো শুনি? আমাকে চলে যেতে বলছ।
সুলতান সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। রানু উঠে চলে গেল। মনে হল সে খানিকটা হলেও অপমানিত বোধ করছে। সুলতান সাহেব পকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে বললেন, মাহফুজ তোমাকে কয়েকটা জরুরি কথা বলার জন্যে রানুকে সরিয়ে দিলাম। রানু অসুস্থ। আমি চাই না সে এইসব কথা শুনুক বা এইসব কথা তাকে কোনভাবে অ্যাফেক্ট করুক।
মাহফুজ অবাক হয়ে বলল, উনার কি অসুখ?
তার কি অসুখ সেটা আমাদের আলোচনার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ না তারপরেও বলছি তার অসুখটা শারীরিক না। মানসিক। সে কিছু ব্যাক্তিগত দুর্যোগের ভেতর দিয়ে গিয়েছে। যার চাপ সে সহ্য করতে পারে নি। তার কিছু মানসিক সমস্যা হয়েছে। সাইকিয়াট্রিস্ট তার চিকিৎসা করছে। আমি যে মেয়েকে নিয়ে এখানে এসেছি এই কারণেই এসেছি। তাকে আলাদা করে একা কিছু সময় দেবার জন্যে এসেছি।
মাহফুজ কিছু বলল না। সে তাকিয়ে রইল। তার তাকিয়ে থাকার ভঙ্গি বোঝা যাচ্ছে সে খুবই দুঃখিত বোধ করছে। সুলতান সাহেব সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন- আমি আমার মেয়েকে সবরকম ঝামেলার বাইরে রাখতে চাই। অথচ তুমি ঝামেলাই তৈরি করেছ। তুমি কোন রকম কথাবার্তা ছাড়া কোয়েশ্চেনেল চরিত্রের একটি মেয়েকে আমার বাড়িতে এনে তুলেছ।
স্যার আপনি…।
কথার মাঝখানে কথা বলবে না। আমার কথা শেষ হোক তারপর যা বলার বলবে। তুমি ঐ মেয়েটিকে আমার এখান থেকে নিয়ে যাবে। এখনি নিয়ে যাবে।
জি আচ্ছা।
রাতে তোমার এই নাটকের যন্ত্রণায় আমাকে জড়াবে না। কাউকে প্রধান অতিথি বা বিশেষ অতিথি করতে হলে তাঁর পূর্ব সম্মতির প্রয়োজন আছে। তুমি আমাকে কিছুই জিজ্ঞেস কর নি…
স্যার আপনি না গেলে…
কথার মাঝখানে কথা বলতে তো নিষেধ করেছি। তারপরেও কথা বলছ কেন? নেভার ডু দ্যাট এগেইন। আমি কয়েকটা দিন একা থাকতে এসেছি। আমাকে একা থাকতে দাও। আমার যা বলার বলেছি এখন তুমি যেতে পার। মেয়েটিকে নিয়ে যেও।
মাহফুজ শুকনো গলায় বলল, জ্বি আচ্ছা।
সুলতান সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, আর শোন মেয়েটির পায়ে না কি কাঁটা ফুটেছে। দয়া করে কাঁটা তোলার ব্যবস্থা করবে।
.
রানু খুবই অবাক।
একটা মেয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। জ্বরে তার গা পুড়ে যাচ্ছে। তাকে এখন নিয়ে যেতে হবে কারণ নাটকের রিহার্সের হবে। কি উদ্ভট কথা। মাহফুজ মাথা নিচু করে বলল, রিহার্সেল লাগবেই। ভুজঙ্গ বাবু বলে পাঠিয়েছেন। উনি খুবই মেজাজী মানুষ। শেষে দেখা যাবে নাটক ফেলে উনি চলে গেলেন।
চলে গেলে চলে যাবেন। প্রয়োজন হলে আমি ভুজঙ্গের সঙ্গে কথা বলব। আমাকে ভুজঙ্গের কাছে নিয়ে চলুন।
চিত্র বিছানা থেকে উঠতে উঠতে বলল, এত ঝামেলা করে লাভ নেই আমি যাই। রিহার্সেল শেষ করে চলে আসব।
রানু বলল, আমি কি রিহার্সেল দেখার জন্যে যেতে পারি?
মাহফুজ বলল, না। ভুজঙ্গ বাবু বাইরের কারো সামনে রিহার্সেল করেন না।
রানুর মনটা হঠাৎ খুব খারাপ হয়ে গেল। চিত্রা মেয়েটাকে তার অসম্ভব ভাল লেগেছে। এত ভাল লেগেছে যে তাকে তার চোখের আড়াল করতে ইচ্ছা করছে না। তার প্রধান সমস্যা এটাই, যাকে ভালো লাগে তাকে চোখের আড়াল করতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু তার ভালোবাসার মানুষরা সবাই চোখের আড়ালে চলে যায়। চিত্রা রিহার্সেল শেষ করে এখানে চলে আসবে এটা এখন আর তার মনে হচ্ছে না। চিত্রা আর আসবে না। মেয়েটার সঙ্গে গল্পই করা হল না। রানু ঠিক করে রেখেছিল পুকুরঘাটটা পরিষ্কার করে সেখানে ইটের চুলা পেতে আজ সে নিজে রান্না করবে! পাশে থাকবে চিত্রা। রান্না করতে করতে গল্প করবে। বনভোজন বনভোজন ভাব চলে আসবে। শ্যাওলা পরিষ্কারের পর যদি দেখা যায় পুকুরের পানি টলটল পরিষ্কার তাহলে তারা দুজন কিছুক্ষণের জন্যে হলেও পানিতে নামবে। কিছুই করা হল না। রানু বাগানে চলে গেল।
নীল পালকের পাখিটা বাগানে নিশ্চয়ই কোথাও আছে। পাখিটাকে খুঁজে বের করতে হবে। সঙ্গে একটা দূরবীন থাকলে ভাল হত। চোখে দূরবীন লাগিয়ে পাখি খোঁজা।
সুলতান সাহেবকে বারান্দায় দেখা যাচ্ছে। তিনি নেমে আসছেন। রানু জানে তিনি এখন বারান্দায় আসবেন। কোন জটিল বিষয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করবেন। ভাবতেই রানুর অসহ্য লাগে। রানু এখন কিছুক্ষণ একা থাকতে চায়। বাবাকে সে কি কঠিন গলায় বলতে পারে না যে তুমি আমাকে কিছুক্ষণ একা থাকতে দাও। তুমি সঙ্গে থাকলে পাখিটা আমি খুঁজে পাব না। হ্যাঁ, নিশ্চয় পারে।
কী করছিস রে মা?
পাখি খুঁজছি।
কী পাখি খুঁজছিস?
নীল পালকের একটা পাখি।
ঠোঁট কী লাল?
হু।
তাহলে মাছরাঙ্গা। মাছরাঙ্গা পাখির বিশেষত্ব জানিস?
রানু শান্ত গলায় বলল, বিশেষত্ব জানি না। এবং বিশেষত্ব জানার আমার কোন ইচ্ছাও নেই। তুমি দয়া করে এখন পাখি বিষয়ক কোন বক্তৃতা শুরু করবে না। আমি একা একা বাগানে বেড়াতে এসেছি। বক্তৃতা শুনতে এখন ইচ্ছা করছে না।
সুলতান সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কোন কারণে কি তোর মনটা বিক্ষিপ্ত?
হা বিক্ষিপ্ত।
কারণটা বলা যাবে?
হ্যাঁ যাবে। কারণ হচ্ছ তুমি।
আমি?
হ্যাঁ তুমি। তুমি মাহফুজ সাহেবকে বলেছ চিত্রা মেয়েটিকে এই বাড়ি থেকে নিয়ে যেতে। বল নি?
সুলতান সাহেব অবাক হয়ে লক্ষ করলেন তাঁর মেয়ে থরথর করে কাঁপছে। এটাতো ভাল কথা না।