মাহফুজ বিব্রত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। রানু বলল, আপনার বিরুদ্ধে তৃতীয় অভিযোগ হচ্ছে চিত্রার পায়ে কাঁটা ফুটেছে, আপনি কাঁটা তোলার ব্যবস্থা করেন নি। শাস্তি হিসেবে এখন আমি আপনাকে পায়ে একটা কাঁটা ফুটিয়ে দেব। মুখ হাসি হাসি করে লাভ নেই। আমি মোটেই ঠাট্টা করছি না।
মাহফুজের বিস্ময়ের সীমা রইল না। মেয়েটির রূপ আগুনের মতো। বিস্ময়ের জন্যে এটাই যথেষ্ট। এমন রূপবতী মেয়ে হঠাৎ হঠাৎ দেখা যায়। কিন্তু সবচে বড় কথা হচ্ছে মেয়েটির সহজ কথা বলার ভঙ্গি। মেয়েটিকে লাগছে দীঘির মতো, যার পানি কাকের চোখের মতো পরিষ্কার। পুকুরের মাঝখানের বালু কণাগুলোও দেখা যাচ্ছে। কণাগুলোও সূর্যের আলো পড়ে ঝলমল করছে।
রানু বলল, আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ এখনো শেষ হয় নি। আপনি চিত্রাকে ধমক দিয়েছেন কেন?
মাহফুজ বলল, ধমক দেই নাই।
অবশ্যই ধমক দিয়েছেন। যখন ঝড় শুরু হল, নৌকা দুলছে। তখন আপনি চিত্রাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি সাঁতার জান?
সেই বেচারী এমি ঝড়ের কারণে ভয়ে অস্থির। সে বলল, সাঁতার জানি না। তখন আপনি ধমকাতে শুরু করলে-কেন সাঁতার জান না। বিরক্তিতে ভূরু-টুরু কুঁচকে ফেলেছিলেন। সে সাঁতার জানে না সেটা তার ব্যাপার। তার ব্যাপারে আপনি ধমকা-ধমকি করবেন কেন? আপনি কি প্লেন চালাতে পারেন? নিশ্চয় পারেন না। এখন যদি আপনাকে আমি ধমকাতে শুরু করি কেন প্লেন চালাতে পারেন না, সেটা কি ঠিক হবে?
প্লেন চালানো আর সাঁতার তো এক জিনিস না।
অবশ্যই এক জিনিস। প্লেনও আকাশে সাঁতার কাটে। এখন আপনি ভেতরে যান। চিত্রা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে। আপনার আসার কথা ছিল খুব ভোরে-এখন বাজে দশটা। এই আপনার খুব ভোর?
মাহফুজ চিত্রার ঘরে ঢুকে গেল।
.
ট্রেতে করে চা নিয়ে রানু উপস্থিত হল। ট্রেতে দুকাপ না তিন কাপ চা। সুলতান সাহেব দেখলেন রানুর পেছনে মাহফুজ মুখ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রানু বলল, বাবা মাহফুজ সাহেব এসেছেন। তোমার সঙ্গে দেখা না করেই চলে যেতে চাচ্ছিলেন। তোমাকে দেখলেই না-কি উনার ভয় লাগে আমি জোর করে ধরে নিয়ে এসেছি। তুমি বকা দিয়ে দাও তো।
বকা দেব?
উনি চিত্রা মেয়েটিকে চব্বিশ ঘন্টা না খাইয়ে রেখেছেন। ওর পায়ে কাঁটা ফুটেছে। কাঁটা তোলার ব্যবস্থা করেন নি।
সুলতান সাহেব ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। এটা তার শোবার ঘর। রানু তার শোবার ঘরে একজনকে নিয়ে উপস্থিত হবে এটা তিনি ভাবেন নি। মাহফুজ এসে তার পা ধরে সালাম করতে করতে বলল- মনটা খুবই খারাপ ছিল স্যার। একঘণ্টা আগে মনটা এত ভাল হয়েছে যে বলার না।
সুলতান সাহেব বললেন, এক ঘন্টা আগে বিশেষ কি ঘটনা ঘটল?
ভুজঙ্গ বাবুর অ্যাসিসটেন্ট চলে এসেছেন। অ্যাসিসটেন্ট বলল, ভুজঙ্গ বাবু সন্ধ্যা নাগাদ চলে আসবেন। ভুজঙ্গ বাবু বলেছিলেন আসবেন কিন্তু ঠিক বিশ্বাস হয় নাই। এই জন্যে বিকল্প ব্যবস্থাও রেখেছিলাম।
ভুজঙ্গ বাবুটা কে?
টিপু সুলতানের পাঠ করবেন। বাড়ি গৌরীপুর। মারাত্মক অভিনেতা। আসল নাম মনোয়ার হোসেন। একবার যাত্রায় ভুজঙ্গ নামে পাঠ করলেন। তারপর থেকে নাম হয়ে গেল ভুজঙ্গ বাবু।
ও আচ্ছা।
ভোটার লিস্টেও উনার নাম ভুজঙ্গ বাবু।
ও।
এদিকে চিত্রা বাবার বিছানায় কাত হয়ে পড়েছে। আমার টেনশান আর কিছুতেই কমে না। একটা কমে তো আরেকটা তৈরি হয়।
মাহফুজ তাঁর সামনে বসেই চুকচুক করে চা খাচ্ছে। তিনি তাকে কিছুই বলতে পারছেন না।
প্লে একটু রাত করে শুরু হবে স্যার। দূর দূর থেকে লোকজন আসবে। এদের ঠিকঠাক মতো বসতে দিতে হবে। আরেকটা ভাল খবরও স্যার আছে–মেরাজকান্দার ছদরুল ব্যাপারী আসবেন।
ছদরুল ব্যাপারীটা কে?
ব্যবসা করেন।
কিসের ব্যবসা?
উনার অনেক ধরণের ব্যবসা আছে। তবে সবচে চালু ব্যবসা হল বিড়ির ব্যবসা। উনি বিশেষ অতিথি। উনার সম্পর্কে অনেক আজেবাজে বদনাম আছে। তবে উনি বিরাট দানশীল মানুষ।
সুলতান সাহেব বিরস মুখে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। আজকের অনুষ্ঠানে একজন বিড়ির ব্যবসায়ীর পাশে তিনি বসবেন। তিনি নিশ্চিত সেই ব্যবসায়ী লুঙ্গি পরেই মঞ্চে উপস্থিত হবে। তার সারা গা থেকে বিড়ির গন্ধ আসবে এটাই স্বাভাবিক।
ছদরুল ব্যাপারীর অবশ্যি আমাদের অনুষ্ঠানে আসার কথা ছিল না। উনি আসবেন মওলানা ইস্কান্দার আলির দোয়া নিতে। এই খবর পেয়ে আমি চেপে ধরলাম। আপনার কথাও বললাম-তখন রাজি হয়েছেন।
সুলতান সাহেব শুকনো মুখে বললেন, আমার কথা বলার দরকার হল কেন?
আপনি এত বড় একজন মানুষ। আপনার কথা আমি বলব না?
.
মাহফুজ আনন্দে ঝলমল করছে। আনন্দের উৎস ছদরুল ব্যাপারী। ব্যাপারী সাহেব বড় ধরনের কোন দান করবেন এটাই কী মাহফুজ আশা করছে? সেই আশাতেই তাকে বিশেষ অতিথি করা হল। তাকে প্রধান অতিথি করার মূলেও এই আশা কাজ করছে। এই গ্রামে তার জায়গা-জমি আছে। তেমন হুলুস্থুল ধরনের কিছু না, কিন্তু আছে। এই বাড়িটা আছে। সে-সব দান করার কথা তিনি ভাবছেন না। জমি-জমা কিছু আছে বলেই তিনি ছুটি ছাটায় ছেলে-মেয়ে নিয়ে আসতে পারেন। সামান্য হলেও একটা যোগসূত্র আছে। সেটা যাতে থাকে সেই চেষ্টা তাকে করতে হবে।
তাছাড়া কয়েকটা পাকা দালান বানিয়ে স্কুল-কলেজ চালু করে দিলেই হয় না। সেই স্কুল-কলেজ যাতে চালু থাকতে পারে সেই ব্যবস্থাও করতে হয়। শিক্ষকদের বেতন, ছাত্র-ছাত্রী জোগাড়। অনেক কিছুই আছে। সেই অনেক কিছুর কথা স্কুল-কলেজের উদ্যোক্তাদের মনে থাকে না। মানুষ অতি বুদ্ধিমান প্রাণী হলেও তার দৃষ্টি মোটামুটি বর্তমানেই আটকে থাকে। ভবিষ্যৎ সে দেখতে পারে না। বা দেখতে পারলেও দেখতে চায় না। সুলতান সাহেব চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে রানুর দিকে তাকিয়ে বললেন, রানু মা, আমি মাহফুজের সঙ্গে কিছু কথা বলব।