মাহফুজ সিগারেট ধরাল। তার সিগারেট ধরানোটা উদ্দেশ্যমূলক। চিত্রা মেয়েটা রোদে কষ্ট পাচ্ছে। সিগারেট ধরাবার উছিলায় ছাতাটা তার হাতে পার করে দেয়া। মুখে বলতে হল না- নাও, ছাতা নাও। বললে মেয়েটা বলবে, জ্বি না লাগবে না। সে তখন বলবে- আহা নাও না। কথা চালাচালি হবে। কী দরকার? ছোট ট্রিকসের কারণে আপসে ছাতা তার হাতে চলে গেল। মাহফুজের এক হাতে স্যুটকেস, অন্য হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। ছাতা সে ধরবে কী ভাবে? তার তো আর হনুমানের মতো লেজ নেই যে লেজ দিয়ে পেঁচিয়ে ছাতা ধরে রাখবে।
চিত্রাকে নৌকায় উঠিয়ে মাহফুজ গেল চায়ের দোকানে। চায়ের তৃষ্ণা হয়েছে- এককাপ চা খাবে। মেয়েটাকে এককাপ চা পাঠাবে। মাটির কলসিতে করে ঠাণ্ডা এক কলসি পানি আর গ্লাস নিতে হবে। ভাদ্রমাসে ঘন ঘন পানির তৃষ্ণা হয়। পথে খাওয়ার জন্যেও কিছু নিতে হবে। চিড়া-মুড়ি। ভাতের ক্ষিধে চিড়া-মুড়ি দিয়ে দূর হবে না। উপায় কী? ডাল-চাল নিয়ে গেলে হয়। নৌকায় চুলা থাকে, মাঝিকে বললেই খিচুড়ি বেঁধে দেবে। তেল মশলা আর লাকড়ির দাম ধরে দিলেই হবে।
চায়ের দোকানের মালিকের নাম নিবারণ। মাহফুজের চেনা লোক। ঠাকরোকোনা এলেই নিবারণের দোকানে চা খায়। দুপুরে ভাত খায়। ভাত খাবার পর ভাতঘুমের ব্যবস্থা আছে। দোকানের পেছনে পাটি পেতে শুয়ে থাকা। মাহফুজ শুয়ে থাকে। চা দোকানের এক ছেলে তালপাখা দিয়ে বাতাস করে। মাথা বানিয়ে দেয়। যতক্ষণ ঘুম ততক্ষণ বাতাস। ফাঁকে ফাঁকে মাথা বানানো। ওস্তাদ ছেলে। একই সঙ্গে বাতাস করা এবং মাথা বানানো সহজ ব্যাপার না।
নিবারণ গ্লাসভর্তি চা মাহফুজের সামনে রাখতে রাখতে বলল, সাথের কইন্যাটা কে?
মাহফুজ চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল, দূর সম্পর্কের বোন হয়। তার জন্যেও চা পাঠাতে হবে! চা আর একটা লাঠি-বিসকুট।
বোন শহরে থাকে?
হু।
কলেজে পড়ে?
হু।
বিবাহ হয়েছে?
না।
মেয়েটা বড়ই সৌন্দর্য।
মাহফুজ হাই তুলতে তুলতে বলল, নিবারণ কাউকে নিয়ে মাথা ধরার টেবলেট আনিয়ে দাও, মাথা ধরেছে।
মাহফুজের সত্যি সত্যি মাথা ধরেছে। পরপর এতগুলো মিথ্যা কথা বলার জন্যেই মাথা ধরেছে। মিথ্যা বলার কোনো দরকার ছিল না। সত্যি কথাটা বলে ফেললেই হত।
মিথ্যা হলো শয়তানের বিয়ের মন্ত্র। মিথ্যা বললেই শয়তানের বিয়ে হয়। বিয়ে হওয়া মানেই সন্তানসন্ততি হওয়া। একটা মিথ্যার পর আরো যে অনেকগুলো মিথ্যা বলতে হয় এই কারণেই। পরের মিথ্যাগুলো শয়তানের সন্তান। এইসব মাহফুজের কথা না, তার দাদীজানের কথা। মাহফুজের দাদী আতরজান সবসময় বলতেন- মিথ্যা কথা কইলে কি হয় জানস? শয়তানের বিবাহ হয়। শয়তানের স্ত্রীর গর্ভে শয়তান শিশুর জন্ম হয়। এই জন্যেই একটা মিথ্যা কথা কইলেই সাথে আরো তিনটা চাইরটা মিথ্যা বলতে হয়। সেই মিথ্যাগুলো হইল শয়তানের সন্তান। বুঝছস কিছু?
দাদীজানের গল্পের কারণে মাহফুজ ছেলেবেলায় যখনি মিথ্যা কথা বলেছে– আতংকে শিউরে উঠেছে সর্বনাশ, শয়তানের বিয়ে হয়ে গেল। এক্ষুণি তাদের ছেলেপুলে হওয়া শুরু হবে। সেই আতংকের ছায়া এখনো খানিকটা আছে। ছোটবেলায় মাথায় কিছু ঢুকে গেলে সহজে বের হয় না।
মিথ্যা বললে সঙ্গে সঙ্গে কিছু কঠিন সত্য কথা বলে শয়তানের বিয়ে ভেঙে দিতে হয়। এও দাদীজানের শেখানো বুদ্ধি। মাহফুজ বিরস মুখে শয়তানের বিয়ে ভাঙার প্রস্তুতি নিল। সত্যি কথা বলতেই হবে।
নিবারণ।
জ্বে।
আমার দূর সম্পর্কের যে খালাতো বোনের কথা বললাম না– কলেজে পড়ে?
জ্বে।
আসলে কলেজে পড়ে না। বিয়ে-শাদি দিতে হবে এই জন্যে বাড়ায়ে বলা। বুঝতে পারছ?
জ্বে পারছি। না বোঝার কিছু নাই। এই সব মিথ্যা বলা যায়। এত ভগবান দোষ ধরেন না।
মেয়েটা নাটক করে। সোহাগীতে টিপু সুলতান প্লে হচ্ছে এই মেয়ে সুফিয়ার পার্ট করবে। এরা খুবই দরিদ্র। নাটক করে টাকা যা পায় তা দিয়ে সংসার চলে।
ভাইজান, মেয়েটা তো খুবই সৌন্দর্য।
সৌন্দর্য কি দেখলা। গায়ের রং ময়লা।
ঠিক বলছেন- সৌন্দর্যের আসল জিনিসটা নাই– রং ময়লা। ভগবানে সব এক লগে দেন না। কিছু দেন। কিছু হাতে রেখে দেন।
মাহফুজের মাথা ধরা কমে গেছে। তারপরেও নিবারণের এনে দেয়া প্যারাসিটামল দুটা খেয়ে ফেলল। রোগ হবার আগেই অষুধ খেয়ে রাখা, যাতে দীর্ঘ যাত্রাপথে মাথা না ধরতে পারে। টুকটাক দু একটা জিনিস কেনা দরকার। টর্চের ব্যাটারি, মোমবাতি। এই দুটা জিনিস ময়মনসিংহ থেকে কিনলে সস্তা পড়ত। এত কিছু কেনা হয়েছে এই দুটা জিনিস কেন কেনা হল না কে জানে।
ভাইজান, চা আরেক কাপ দিব?
দাও।
চা খেতে ইচ্ছা করছে না, তারপরেও খাওয়া। মাহফুজের ধারণা তার জ্বর আসছে। কোনো কিছুই ভাল লাগছে না। চায়ে চুমুক দিতেই জিহ্বায় সর আটকে গেল। বমি ভাব হল। বমি ভাব হলেও খাওয়ার জিনিস নষ্ট করা যায় না।
দাদীজান বাঁশের চোঙায় খটখট করে সুপুরি হেঁচতে হেঁচতে বলতেন- মানুষ যখন খাওয়া-খাইদ্য খায় তখন তার পায়ের কাছে কে বইস্যা থাকে ক দেহি? শয়তান বইস্যা থাকে, আর কানের কাছে কুমন্ত্রণা দেয়- খাইস নারে ভাত খাইস না। পাতে ভাত রাইখ্যা উইঠ্যা আয়। লক্ষীমনা পাতের ভাত সব শেষ করনের কোনো দরকার নাই। কুমন্ত্রণা শুইন্যা মানুষ পাতে ভাত রাইখ্যা উইঠা যায়। তখন শয়তানের খুশির সীমা থাকে না। বাহাতুরটা দাঁত বাইর কইরা হাসে। মানুষের দাঁত বত্রিশ, শয়তানের বাহার। শয়তান দাঁত বাইর কইরা ক্যান হাসে জানস? হাসে কারণ হইল পাতের প্রত্যেকটা না খাওয়া ভাত রোজ হাশরে সঙ্কুরটা কইরা সাপ হইয়া দংশন করব। বুঝছস?