নাশতা শেষ করে সুলতান সাহেব কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে রইলেন। তারপর কাগজ কলম নিয়ে বসলেন। কিছু একটা লিখতে ইচ্ছা করছে। কী লিখবেন বুঝতে পারছেন না। গুছিয়ে কাউকে একটা চিঠি লিখতে পারলে হত। চিঠি লেখার তার মানুষ নেই। তিনি লিখেন সরকারি চিঠি। সেই চিঠি কোন মানুষকে লেখা হয় না। সরকারি কোন পদধারীকে লেখা হয়। সেইসব চিঠিতে কখনো লেখা থাকে না– ভাই আপনার শরীর এখন কেমন যাচ্ছে?
রানু দরজা ধরে দাঁড়াল। সুলতান সাহেব বললেন, কিছু বলবি?
রানু বলল, আমি কিছু বলব না। তোমার কি আরেক কাপ চা লাগবে?
না।
কি লিখছ?
কিছু লিখছি না।
কিছু লিখছ না তাহলে কলম হাতে বসে আছ কেন?
বন্দুক হাতে বসে থাকলেই যে গুলি করতে হবে এমন কথা নেই। ঠিক তেমনি কলম হাতে বসলেই লিখতে হবে এমন কথা নেই। তুই নাশতা করেছিস?
হ্যাঁ।
মেয়েটা নাশতা করেছে।
চিত্রার শরীরটা ভাল না বাবা। একটা পারাটার সামান্য একটা টুকরা মুখে দিয়ে বেচারী আর খেতে পারেন নি। আমি গায়ে হাত দিয়ে দেখেছি জ্বর। বেশ জ্বর, এখন শুয়ে আছেন।
জ্বর নিয়ে নাটক করবে কিভাবে?
আমিও সেই কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনি বললেন, কোন অসুবিধা হবে না। একবার না-কি একশ তিন জ্বর নিয়ে নাটক করেছেন।
মাহফুজ ছেলেটা কি জানে তার অভিনেত্রী অসুস্থ?
আমি খবর পাঠিয়েছি।
মাহফুজ এলেই ওকে আমার কাছে পাঠাবি।
আচ্ছা।
দুই কাপ চা নিয়ে আয়।
দুই কাপ কেন?
এক কাপ তোর জন্যে এক কাপ আমার জন্যে। আয় চা খেতে খেতে বাপ-বেটিতে কিছুক্ষণ গল্প করি।
বিশেষ কিছু বলবে?
হ্যাঁ।
দিনেরবেলা বিশেষ কথা শুনতে ইচ্ছে করে না বাবা। বিশেষ কথা শুনতে হয় রাতে। তোমার বিশেষ কথা রাতে শুনব।
কথা না শুনলি, আয় একসঙ্গে চা খাই।
আসছি। বাবা, তুমি কিন্তু এখনো চিত্রার পায়ের কাঁটা তোলার ব্যবস্থা কর নি। আমার মনে হচ্ছে পা খুঁচাখুঁচি করেই সে ইনফেকশন বাঁধিয়েছে। একজন ডাক্তার আনাও।
গণ্ডগ্রামে হৈ করে ডাক্তার পাওয়া মুশকিল। দেখি কি করা যায়।
.
সুলতান সাহেব রানুর সঙ্গে যেসব কথা বলবেন বলে ঠিক করেছেন তা গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করলেন। কোন কথাটার পর কোনটা বলবেন। সিঁড়ি গেঁথে গেঁথে ওঠা। স্টেপগুলো এমন হবে যে খুব সহজে টপকানো যায়। যেন হাঁপ না ধরে।
প্রথম শুরুটা করবেন ধর্ম বিষয়ক আলোচনা দিয়ে বুঝলি রানু আমাদের এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে শুধু যে পৃথিবী নামক গ্রহেই মানুষ এসেছে তা তো না। আরো অনেক গ্রহেই এসেছে। এর উল্লেখ কিন্তু কোরান শরীফে আছে। সূরা জাসিয়ার ৩৬ নং আয়াতে বলা আছে–
All praise be to Allah Sustainer and nourisher. Of the Heavens, and Sustainer and nourisher Of the Earth. Sustainer and nourisher Of the worlds
এই সূরায় পরিষ্কার করে বলা হয়েছে তিনি পৃথিবীর পরিচালক, আসমানের পরিচালক এবং জগতসমূহের পরিচালক। রানু তখন নিশ্চয়ই বলবে কি আশ্চর্য, কোরান শরীফে এই কথা আছে? তিনি বলবেন– কোরান শরীফে আরো অনেক আশ্চর্য কথা বলা হয়েছে যা আধুনিক বিজ্ঞান বলছে। যেমন ধর ইউনিভার্স সৃষ্টি হল বিগ ব্যাং এর মাধ্যমে। তারপর থেকে কি হচ্ছে বিশ্বব্রাহ্মণ্ড ছড়িয়ে পড়ছে। একে বলা হয় expanding Universe. সূরা যরিনার সাতচল্লিশ নম্বর আয়াতে আছে —
We created the Heaven with a
Twist of the (Divine) Hand.
And surely we are expanding it.
গেট দিয়ে সংকুচিত ভঙ্গিতে একজন ঢুকছে। যে ঢুকছে তাকে রানু আগে কোনদিন দেখেনি তবু সে চট করে চিনে ফেলল– লোকটা আর কেউ না মাহফুজ। লোকটা এমন সংকুচিতভাবে ঢুকল কেন? সে-তো কোন রাজবাড়িতে ঢুকছে না। গেটে দারোয়ান নেই যে দারোয়ান তাকে ঢুকতে দেবে না। মানুষটার সার্টের একটা বোতাম লাগানো নেই। এই ব্যাপারটা খুব চোখে পড়ছে। খাবার সময় কারো ঠোঁটের কাছে যদি একটা ভাত লেগে থাকে এবং সে সেটা না জানে তখন অস্বস্তিতে রানুর গা কিটকিট করে। তার ইচ্ছে করে পেপার নেপকিন দিয়ে সে নিজেই ভাতটা সরিয়ে দেয়।
ঘরে কি কোন বোতাম আছে? লোকটার শার্টে একটা বোতাম কি লাগিয়ে দেয়া যায় না? আচ্ছা লোকটার গলার স্বর কেমন? গলার স্বর রানুর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কারো গলার স্বর পছন্দ না হলে তাকে রানুর কখনোই পছন্দ হবে না। সে যত ভাল লোকই হোক কিছুই যায় আসে না। মাহফুজ নামের মানুষটা দেখতে সুন্দর। অবশ্যি চোখের কাছে একটা বোকা বোকা ব্যাপার।
মাহফুজ রানুর সামনে দাঁড়াতেই রানু বলল, মাহফুজ সাহেব, আপনি ভাল আছেন?
মাহফুজ থতমত খেয়ে বলল, জ্বি।
রানু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল-মানুষটার গলার স্বর ভাল। শুধু ভাল না বেশ ভাল। গলার স্বর শুনলেই মনে হয় মানুষটা তার নিজের কেউ। যার সঙ্গে ফাজলামি করা যাবে। রসিকতা করা যাবে। ধমক-ধামক দেয়া যাবে। রানু বলল, আপনি সারা গ্রামে বিজ্ঞাপন দিয়ে ফেলেছেন, আপনি কি জানেন বিজ্ঞাপনে দুটা বানান ভুল? প্রধান বানান ভুল, অতিথি বানানও ভুল। যেহেতু বাবা প্রধান অতিথি তিনি ভুল বানান দেখে খুব রাগ করেছেন। আপনি আজ যাবার সময় আমার কাছ থেকে শুদ্ধ বানান জেনে যাবেন এবং বিজ্ঞাপনের বানানগুলো ঠিক করবেন।
মাহফুজ বলল, জ্বি আচ্ছা।
আপনার বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ আছে। আপনি একটা মেয়েকে এখানে রেখে গেছেন রাতে খাবার ব্যবস্থা করেন নি।