চিত্রা বলল, আমাদের দুজনের মধ্যে বড় একটা মিল আছে। তুমি অনেক মিল খুঁজে বের করলেও এই মিল কখনো বের করবে না।
রানু বলল, কি মিল?
চিত্রা বলল, আমরা দুজনই মেয়ে।
রানু হেসে ফেলল। মেয়েটাকে এত অল্প সময়ে তার এত পছন্দ হচ্ছে। কেন সে বুঝতে পারছে না।
রানু হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, আচ্ছা শোন, তোমার মাথায় কি মাঝে মাঝে অদ্ভুত পাগলামী আসে।
কি রকম পাগলামী?
যেমন ধর এক গাদা ঘুমের অসুধ খেয়ে ফেলা। ব্লেড দিয়ে হাতে আঁচড় দেয়া?
না, এরকম পাগলামী আমার মধ্যে নেই।
আমার কিন্তু আছে। একবার আমি কি করেছিলাম শোন, পেন্সিল কাটারের যে ব্লেড আছে, সেই ব্লেড স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে খুলেছি। তারপর সেই ব্লেড দিয়ে হাতের গোড়া থেকে কব্জি পর্যন্ত কেটেছি। তুমি ভেবেছ একটা দাগ দিয়েছি? তা না অসংখ্য দাগ দিয়েছি। সেই গদা এখনো আছে। আমি যে ফুল হাতা ব্লাউজ পরেছি এই জন্যে পরেছি। নাশতা খাওয়া হোক তারপর আমি তোমাকে দাগ দেখাব।
চিত্রা অবাক হয়ে তাকাল। রানু বলল, এখন তোমার কাছে মনে হচ্ছে না আমার মাথা পুরোপুরি খারাপ? শুধু যে হাতে দাগ দিয়েছি তা না, সারা শরীর দাগ দিয়েছি। এমন সব জায়গায় দিয়েছি যা কাউকে দেখানো যায় না। তবে তোমাকে দেখাব।
কেন এরকম কর?
রানু হাসতে হাসতে বলল, জানি না কেন করি।
.
শুধু যে অধিক শোকে মানুষ পাথর হয় তা-না অধিক রাগেও মানুষ পাথর হয়। সুলতান সাহেব হয়েছেন। তিনি শান্ত ভঙ্গিতে চা খাচ্ছেন। প্রচণ্ড রাগের কিছুই তার চোহরায় নেই। তিনি বরং অন্যদিনের চেয়েও শান্ত। তবে সিগারেট ধরাবার সময় তিনি লক্ষ করলেন তার হাতের আংগুল সামান্য কাঁপছে। ঘটনাটা রাগ চেপে রাখার কারণেই ঘটছে তা বোঝা যাচ্ছে। তিনি এই কিছুক্ষণ আগে রানুর কাছে শুনেছেন থিয়েটারের একটি মেয়ে গত রাতে তার বাড়িতে ছিল। মেয়েটার নাম চিত্রা।
সুলতান সাহেব বললেন, ও আচ্ছা।
এমনভাবে বলছেন যেন থিয়েটারের মেয়ে থাকতেই পারে।
রানু বলল, কি কাণ্ড দেখ বাবা। মেয়েটা চব্বিশ ঘণ্টা কিছু খায় নি। এক লোক গভীর রাতে তাকে এ বাড়িতে ফেলে রেখে উধাও হয়ে গেছে। আর তার কোন ট্রেস নেই। ভোরবেলায় যে সে এসে খোঁজ নেবে তাও এখন পর্যন্ত নেয় নি।
সুলতান সাহেব আবারও বললেন, ও আচ্ছা।
তারপরও ঘটনা আছে। মেয়েটার পায়ে কাঁটা ফুটেছে। বাবা তোমাকে পায়ের কাঁটা বের করার ব্যবস্থা করতে হবে।
সুলতান সাহেব মেয়ের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলেন।
তুমি চা খাও বাবা। আমি চিত্রার সঙ্গে গল্প করতে করতে নাস্তা খাব।
রানু ব্যস্ত ভঙ্গিতে চলে গেল। প্রচণ্ড রাগে সুলতান সাহেব জমে গেলেন। মওলানা ইস্কান্দার আলির কথা তিনি অবিশ্বাস করেছিলেন, এখন দেখা যাচ্ছে মওলানা সত্যি কথাই বলেছে। খারাপ একটা মেয়েকে সত্যি সত্যি তার বাড়িতে এনে তুলেছে। এরা তাকে জিজ্ঞেস করার কোন প্রয়োজন মনে করে নি।
এই মুহূর্তেই মেয়েটাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া দরকার। কিন্তু তা তিনি রানুর জন্যেই করতে পারবেন না। জগতের জটিলতা সম্পর্কে রানুর ধারণা নেই। সে পৃথিবীকে দেখছে শাদা চোখে। রানুর দৃষ্টি আহত না করে তাকে আগাতে হবে। মেয়েটিকে বের করে দিতে হবে এমনভাবে যে রানুর কাছে ব্যাপারটা স্বাভাবিক মনে হবে। মাহফুজ নামের ছেলেটিকেও একটা কঠিন শিক্ষা দিতে হবে। এমন শিক্ষা যেন তার অনেক দিন মনে থাকে। ধরাকে কেউ কেউ সরা মনে করে। এই ছেলে সরাও মনে করছে না। পিরিচ মনে করছে। রমিজকে পাঠিয়ে স্কাউভ্রালটাকে কান ধরে নিয়ে আসা দরকার। তবে তিনি তা করবেন না। তিনি একজন ডিপ্লোমেট। কোন ডিপ্লোমেটই কখনো হুট করে কিছু করে না। তারা সময় নেয়। মহেন্দ্রক্ষণের জন্যে অপেক্ষা করে। তিনিও করবেন। হাসিমুখেই অপেক্ষা করবেন। রোজ যেমন গ্রামের ভেতর দিয়ে একটা চক্কর দেন, আজও দেবেন। ভেঙে পড়া মসজিদটা একবার দেখতে যেতে হবে। মসজিদের ইটগুলো রক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। আর্কিওলজি বিভাগের কেউ এসে দেখুক। মসজিদ দেখতে গিয়ে মাহফুজ ছেলেটাকে ডেকে পাঠানো যেতে পারে। সেটা ঠিক হবে না। নিজের বাড়ির বাইরে তিনি যেখানেই গেছেন তাঁকে ঘিরে লোকজন জমা হয়েছে। কঠিন কথা সাক্ষী রেখে বলতে হয় না। মাহফুজকে নিজের বাড়িতেই ডেকে পাঠাতে হবে। তখন তার সঙ্গে যে কথাগুলো বলবেন সব ঠিক করে রাখতে হবে। প্রথম কথাটা হল
মাহফুজ সন্ধেবেলা তোমাদের নাটকে আমি যেতে পারব না। আমি পাবলিক ফাংশান থেকে দূরে থাকতে চাই। সারাজীবন তাই থেকেছি ভবিষ্যতেও তাই থাকব।
আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, আমাকে কিছু না বলে কোয়েশ্চেনেবল ক্যারেক্টারের একটা মেয়েকে রেখে গেছ। এই কাজটা শুধু যে ঠিক করো নি তা না। অপরাধ পর্যায়ের একটা কাজ করেছ। আধঘন্টার মধ্যে মেয়েটিকে অন্য কোথাও নিয়ে যাবে। এবং এই কাজ যে তুমি আমার নির্দেশে করেছ তা যেন আমার মেয়ে না জানে। এখন আমার সামনে থেকে বিদেয় হও।
এই মেঘ, রৌদ্রছায়! কোনো মানুষই ভেবে রাখা কথা ঠিকঠাক বলতে পারে না। কোথাও না কোথাও গুবলেট করে ফেলে। সুলতান সাহেবের ব্যাপারে এরকম কখনো হয় না। যে-কথা যেভাবে বলবেন বলে তিনি ভাবেন সেই কথা তিনি ঠিক সেই ভাবেই বলতে পারেন।
সুলতান সাহেব সকালের নাশতা একা একা করলেন। এই সময় রানু তার সামনে থাকে। আজ সে খুব সম্ভব নষ্ট মেয়েটির সঙ্গে আছে। এবং সেটাই স্বাভাবিক। ভালমানুষের সঙ্গ কখনোই ইন্টারেস্টিং হয় না। মন্দ মানুষের সঙ্গ ইন্টারেস্টিং হয়। যে যত মন্দ তার সঙ্গ ততই আনন্দময়।