আমাদের বাগানটা খুব সুন্দর না?
খুব সুন্দর।
পুকুর-ঘাট দেখেছেন? পুকুর-ঘাট আরো সুন্দর। পুকুরটা অবশ্যি সুন্দর না। সবুজ শ্যওলা এমনভাবে পড়েছে যে পানি দেখা যায় না। তবে বাঁধানো ঘাটটা খুব সুন্দর। চলুন আপনাকে পুকুর-ঘাট দেখাই। আপনি কদিন থাকবেন?
আজ রাতটা থাকব।
পরশু যাবেন?
জ্বি।
তাহলে খুবই ভাল। আপনি আমাদের সঙ্গে যেতে পারবেন। আমরাও পরশু যাচ্ছি। বাবার বোধ হয় আরো কয়েকদিন থাকার ইচ্ছা কিন্তু আমার অসহ্য লাগছে।
রানুর মনে হল মেয়েটা ঠিক সহজ হতে পারছে না। প্রশ্ন করলে জবাব দিচ্ছে ঠিকই। নিজ থেকে কিছু বলছে না। মনে হচ্ছে খুব লজ্জা পাচ্ছে। নাটক-থিয়েটারের মেয়েদের এত লজ্জা থাকার কথা না। তাদের অনেকের সঙ্গে মিশতে হয়। অনেকের সঙ্গে কথা বলতে হয়।
রানু বলল, রাতে আপনার ঘুম কেমন হয়েছে।
ভাল হয় নাই।
নতুন জায়গা ঘুম ভাল হবার কথা না। আমারও একই অবস্থা। কোন নতুন জায়গায় গেলে প্রথম রাতে আমার এক ফোঁটা ঘুম হয় না। মনে হয় ঘুমিয়ে পড়লেই দরজা ভেঙে ছয়-সাত জন ষণ্ডাগুণ্ডা ঢুকে পড়বে। যতবার বিছানায় যাই ততবারই মনে হয় দরজা ঠিকমতো লাগান হল না। বিছানা ছেড়ে উঠে ছিটকিনি পরীক্ষা করি। বিছানায় আবারও ঘুমুতে যাই। তখন আবারও মনে হয় ছিটকিনি দেয়া হয়নি। অথচ আগেই ছিটকিনি দেখে এসেছি। আপনারও কি সেরকম হয়?
না। কাল রাতে আমার ঘুম হয় নি অন্য কারণে।
কারণটা কি আমাকে বলা যাবে?
জ্বি-না বলা যাবে না।
বলতে ইচ্ছা না হলে বলতে হবে না।
রানু চিত্রার দিকে তাকিয়ে আছে। চিত্রা মাথা নিচু করে হাসল। চিত্রার মনে হল কাল রাতে ঘুম না হবার কারণটা এই অদ্ভুত সুন্দর মেয়েটাকে বলা যেতে পারে। এতে দোষের কিছু হবে না। চিত্রা হাসতে হাসতে বলল, আচ্ছা আপনাকে বলি। কাল রাতে ক্ষিধার জন্যে ঘুম হয় নি।
তার মানে?
সারাদিন নৌকায় কিছু খাওয়া হয় নি। মাহফুজ ভাই অনেক রাতে এ বাড়িতে রেখে গেছেন। তখনো খাওয়ার কথা কিছু বলেন নাই। রেখেই চলে গেছেন।
একটা পুরো দিন আর পুরো রাত আপনি না খেয়ে কাটিয়েছেন?
চিত্রা আবারও হাসল। রানু বলল, আমার খুব রাগ লাগছে। আপনি খাবার দেয়ার কথা মাহফুজ ভাইকে বলতে পারলেন না।
বলার ইচ্ছা করছিল কিন্তু বলতে পারি নাই।
রানু বলল, আই এ্যাম সরি। আই এ্যাম সো সরি। আমার খুবই খারাপ লাগছে।
আপনার খারাপ লাগবে কেন?
আমার বাড়িতে একটা মেয়ে না খেয়ে থাকবে আর আমার মন খারাপ লাগবে না? আপনি এক মিনিট দাঁড়ান। আমি রমিজ ভাইকে নাস্তার কথা বলে আসছি। আরেকটা কথা, আপনার পায়ে কি কোন সমস্যা? পা টেনে টেনে হাঁটছেন।
কাল রাতে এখানে আসার সময় কাঁটা ফুটেছে। বের করতে পারি নি।
আচ্ছা দাঁড়ান আমি ব্যবস্থা করছি।
কি ব্যবস্থা?
বাবাকে বলব। উনি ব্যবস্থা করবেন। যে কোন সমস্যা বাবা সমাধান করতে পারেন। সমস্যা জটিল হোক বা সহজই হোক। আপনি দাঁড়িয়ে থাকুন, আমি আসছি। হাঁটাহাঁটি করার দরকার নেই।
চিত্রা দাঁড়িয়ে আছে। তার খুবই অবাক লাগছে। বিছানার চাদর গায়ে দিয়ে একটা মেয়ে এসেছে। সিঁড়ি দিয়ে যখন নামছিল তখন মনে হচ্ছিল উড়তে উড়তে নামছে। এখন আবার পাখির মতই উড়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। দ্রুত যাচ্ছে বলে গায়ের চাদর পাখির ডানার মত পাখা মেলেছে। মেয়েটা এত সুন্দর সেটাও একটা বিস্ময়কর ঘটনা। মানুষ এত সুন্দর হয় কিভাবে? চিত্রার বয়স উনিশ। সে তার উনিশ বছর বয়সে এত সুন্দর মেয়ে দেখেছে বলে মনে করতে পারল না। সঙ্গে ক্যামেরা থাকলে মেয়েটাকে পাশে নিয়ে সে ছবি তুলত। সেই ছবি মাকে দেখিয়ে বলত, মা দেখ পরীর মেয়ের সঙ্গে ছবি তুলেছি।
মা অবশ্যই ছবি দেখে নানান খুঁত বের করত। চোখ ছোট, নাক মোটা, হাঁটা ভাল না।
সে তখন মাকে চেপে ধরত, ছবি দেখে কি করে বুঝলে হাঁটা ভাল না। ছবিতে কি মেয়েটা হাঁটছে? তোমার নিজের ঠ্যাং নেই বলে তোমার কাছে মনে হয় জগতের সব মেয়ের হাঁটা খারাপ।
চিত্রার মন একটু খারাপ হয়ে গেল। নৌকা থেকে নামার পর থেকে একবারও মার কথা মনে হয় নি। এই প্রথম মনে হল। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার সে মাকে কত দ্রুতই না ভুলে যেতে পারছে। ময়মনসিংহ ফিরে গিয়ে সে যদি দেখে মা মারা গেছেন তাহলে সে খুব কি কষ্ট পাবে? হ্যাঁ, কষ্ট পাবে। তবে ভয়াবহ কষ্ট না। কষ্টের চেয়ে বেশি হবে দুঃশ্চিন্তা। সে থাকবে কোথায়? যাবে কার কাছে?
রানু এসে পাশে দাঁড়াল। হড়বড় করে বলল, পরোটা বানাতে বলে এসেছি। পরোটা আর গোশত। রাতের গোশত আছে। ঐটা গরম করে দেবে। আর ডিম ভেজে দেবে। ঠিক আছে?
চিত্রা গম্ভীর গলায় বলল, না হবে না। আমি পোলাও কোর্মা খাব। আর রুই মাছ ভাজা খাব।
চিত্রা কথাগুলো এমনভাবে বলল যে রানুর প্রথমে মনে হল মেয়েটা সত্যি সত্যি পোলাও কোর্মা খেতে চাচ্ছে। রহস্য করে যে কথা বলে সে
কথা শেষ করে ফিক করে হসে ফেলে। এই মেয়ে হাসছেও না। কথা শেষ করে আরো গম্ভীর হয়ে গেছে। বাহ্ মজার মেয়ে তো।
রানু বলল, আমি তোমাকে তুমি করে বলি? আমার বয়েসী কোন মেয়েকে আমি বেশিক্ষণ আপনি বলতে পারি না। তোমার বয়স কত?
উনিশ।
রানু প্রায় চেঁচিয়ে বলল, কি আশ্চর্য আমার বয়সও উনিশ। আমার একটা স্বভাব কি জান? যাকে আমার পছন্দ হয় আমি শুধু তার সঙ্গে আমার মিল খুঁজে বের করতে থাকি।