মাহফুজ পকেট থেকে একশ টাকার একটা নোট বের করল। চিত্রা খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই সেই নোটটা হতে নিল।
রানু লেট রাইজার
০৪.
রানু লেট রাইজার। সকাল নটার আগে সে বিছানা থেকে নামে না। কিন্তু গ্রামে এসে তার সিস্টেম কিছু গণ্ডগোল হয়েছে। যত রাতেই সে ঘুমুতে যায় না কেন ভোরবেলা পাখির কিচিমিচিতে ঘুম ভাঙে। পাখিদের হল্লা এলার্ম বেলের চেয়েও তীব্র ও তীক্ষ্ণ। পাখিদের চেঁচামেচিতে সে অভ্যস্ত নয় বলেই ভোরবেলা ঘুম ভাঙার ব্যাপারটা ঘটছে বলে রানুর ধারণা। রানু এতে বিরক্ত না। বরং সকালবেলা জেগে ওঠাটা তার ভাল লাগছে। ঘুম-ঘুম চোখে কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা। সকাল হওয়া দেখা। পাখিদের এক গাছ থেকে আরেক গাছে ঝাঁপ দেয়ে দেখা। তারপর সিঁড়ি বেয়ে একতলায় নামা। একতলায় নামার সঙ্গে সঙ্গে রমিজ হাতে এককাপ চায়ের কাপ ধরিয়ে দেয়। আগুন-গরম ধোয়া ওঠা চা। সকালের এই অংশটাও রানুর পছন্দ। রমিজ অন্য কাজকর্ম তেমন পারে না বা পারলেও করে না, তবে রানুকে দেখামাত্র অতিদ্রুত চা বানানোর কাজটা খুব ভাল পারে। শুধু একটাই দোষ কাপটা থাকে কানায় কানায় ভর্তি। প্রতিবারই রানু বলে এমন ভর্তিকাপ দেবেন না। প্রতিবারই রমিজ মাথা কাত করে বলে, জ্বি আচ্ছা আপা। আবার প্রতিবারই এই ভুল করে।
আজ রানু অন্যদিনের চেয়েও সকালে উঠেছে। শীত শীত লাগছিল বলে চাদরটা গায়ে দিয়ে চলে এসেছে। বিছানার চাদর জড়ানোয় তাকে দেখাচ্ছে কোলবালিশের মত। মা দেখতে পেলে খুব রাগতেন। ভাগ্যিস তিনি এখানে নেই। উঠানে দাঁড়িয়ে রানু মুগ্ধ হয়ে গেল। প্রতিদিনই মুগ্ধ হয়, আজকের মুগ্ধতাটা অন্যদিনের চেয়ে বেশি। কারণ আজ রেলিং-এ অদ্ভুত সুন্দর একটা পাখি বসে আছে। পাখিটার গায়ের পালক ময়ূরের পালকের মতো গাঢ় নীল। ঠোঁট টকটকে লাল। পাখিটা রানুকে ঘাড় কাত করে দেখল। আশ্চর্যের ব্যাপার উড়ে চলে গেল না। যেন সে বুঝতে পেরেছে রানু নামের মেয়েটাকে ভয় পাবার কিছু নেই। বিছানার চাদর গায়ে দিয়ে কোলবালিশ সেজে চলে এলেও সে খুব ভাল মেয়ে।
কাক ছাড়া অন্য কোন পাখি মানুষকে বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারে না। কাজেই নীল-পালকের পাখি এক সময় উড়ে গেল বাগানের দিকে। রানু পাখি কোথায় গেল দেখতে গিয়ে অন্য একটা দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
তার বয়সী সুন্দর একটি মেয়ে বাগানে একা-একা হাঁটছে। মেয়েটির হাতে চায়ের কাপ। মাঝে মাঝে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। মেয়েটার মাথা ভর্তি চুল। চা খেতে খেতে সে নানান দিকে মাথা দুলাচ্ছে বলে মাথার চুল। পর্দার মতো দুলছে। সে আবার বিড়বিড় করে পাগলের মত কি যেন বলছে। আবার হাসছেও।
অচেনা একটা মেয়ে চা খেতে খেতে তাদের বাগানে হাঁটার ব্যাপারটা কী? এটা স্বপ্নের কোন দৃশ্য না-তো। রানুর কিছু কিছু স্বপ্ন বাস্তবের মতো স্পষ্ট হয়। এখানেও কী তাই হচ্ছে।
মেয়েটি এখন তাকে দেখতে পেয়েছে। চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি স্থির। রানুর মনে হল মেয়েটার গায়ে রঙ ময়লা হলেও খুবই মায়াকাড়া চেহারা। বয়সও মনে হচ্ছে তার চেয়ে কম। তবে কালোমেয়েদের বয়স সহজে বোঝা যায় না। যা তাদের বয়স তারচেয়েও তাদের অনেক কম দেখায়। রানু সিঁড়ি বেয়ে নামছে। একবার মনে হল মেয়েটার সঙ্গে কথা বলার আগে গায়ের চাদরটা ফেলে যাওয়া দরকার। তারপরই মনে হল থাক না চাদর।
রমিজ মনে হয় চায়ের কাপ নিয়ে তৈরিই ছিল। রানু সিঁড়ির গোড়ায় নামতেই হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিল। রানু বলল, মেয়েটা কে?
রমিজ বলল, নাটকের মেয়ে।
নাটকের মেয়ে মানে কি?
টিপু সুলতান নাটক যে হইব তার মেয়ে। ময়মনসিংহ থাইক্যা ভাড়া কইরা আনছে।
আমাদের এই বাগানে সে কি করছে?
বেড়াইতেছে। শহরবন্দরে থাকে গেরামের বাগান দেখে নাই। দেইখ্যা মজা পাইতেছে।
তা মজা পাক কিন্তু আমাদের এই বাগানে সে কিভাবে এল?
রাত্তিরে আমরার বাড়িত ছিল। আফনেরা ঘুমাইয়া পড়ছিলেন তহন মাহফুজ ভাই নিয়া আসছে।
আমাদের এখানেই কি তার থাকার কথা ছিল?
এই বাড়ি ছাড়া আর কই থাকব? আর থাকনের জাগা আছে?
মেয়েটার নাম কি?
নাম জানি না আফা।
রানু এগিয়ে গেল। তার কাছে পুরো ব্যাপারটা এখনো অদ্ভুত লাগছে। এবং এখন কেন জানি মনে হচ্ছে মেয়েটার সঙ্গে কথা বলে তার ভাল লাগবে। গ্রামে আসার পর থেকে সারাক্ষণ বাবার বক্তৃতা ধরনের কথা শুনে শুনে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আসল বক্তৃতা তিনি এখনো দেন নি। এই কদিন যা হয়েছে তা আসল বক্তৃতার রিহার্সেল। আসল বক্তৃতা নিশ্চয়ই ভয়াবহ হবে। বক্তৃতা ছাড়াও বাবা আজকাল তুচ্ছ বিষয় নিয়েও অনেক বেশি কথা বলেন। ব্যাপারটা মনে হয় বয়সের কারণে হচ্ছে। বয়স্ক মানুষ যে কোন কাজে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, শুধু কথা বলায় তাদের ক্লান্তি নেই।
রানু মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে বলল, আপনি কেমন আছেন?
চিত্রা নিচু গলায় বলল, ভাল আছি।
আপনি যে রাতে আমাদের বাড়িতে ছিলেন জানতাম না। ঘুম ভেঙ্গেই আপনাকে দেখে চমকে গেছি। প্রথমে ভেবেছিলাম স্বপ্ন দেখছি। আপনার নাম কি?
চিত্রা।
আমার ডাক নাম রানু। আমি এই বাড়ির মেয়ে।
আমি জানি।
রমিজ নিশ্চয়ই আপনাকে সব বলেছে।
জ্বি।