আপনাকে জগতের নিয়ম ব্যাখ্যা করার দরকার নেই। মূল ব্যাপারটা বলুন।
মেয়েটা থাকবে আপনার বাড়িতে। এটা জনাব ঠিক হবে না। আপনি যে বাড়িতে থাকেন- রানু মা যে বাড়িতে থাকে।
আমার বাড়িতে থাকবে মানে? কই আমি তো কিছু জানি না। আমাকে কিছু না জানিয়ে আমার বাড়িতে একটা প্রসটিটিউট এনে তুলবে? কি বলছেন এসব?
তাহলে জনাব আমি ভুল শুনেছি। এরা আলাপ-আলোচনা করছিল সেখান থেকে শুনলাম।
শুনুন ইস্কান্দার সাহেব, আমি আমার মেয়েকে নিয়ে কয়েকটা দিন নিরিবিলিতে থাকার জন্যে এসেছি। বিশেষ কিছু দুর্ভাগ্যজনক কারণে আমার মেয়েটার মন অত্যন্ত খারাপ। কথাবার্তা বলে আমি মেয়েটার মন ভাল করতে চাই। এর মধ্যে বাইরের কেউ এসে আমাদের সঙ্গে থাকবে সে প্রশ্নই আসে না।
ইস্কান্দার আলি খাওয়া বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে নিচু গলায় বললেন রানু মার কি হয়েছে?
তার কি হয়েছে সেটা আপনার জানার প্রয়োজন নেই।
জ্বি জনাব, অবশ্যই। আমার ভুল হয়েছে। ক্ষমা করে দেন।
আপনি কিছু খাচ্ছেন না। খান।
রানু সবুজ মিষ্টির বাটির নিয়ে ঢুকল। হাসি মুখে বলল, আপনাকে এই মিষ্টি রান্না করা শিখিয়ে দিয়ে যাব। খুব সহজ। সবুজ রং-টা কোন ব্যাপার না। এটা হল ফুড কালার। একটা শিশি আপনাকে দিয়ে যাব। আপনি রান্না-বান্না করতে পারেন না?
জ্বি আম্মা পারি। ডাল-ভাত, আলু-ভর্তা এই সব। জটিল কিছু পারি না।
রানু-পছন্দ মিষ্টি বানানো জটিল কিছু না। ইনগ্রেডিয়েন্টসও সবই হাতের কাছে পাবেন। শুধু শাদা সির্কা লাগবে। শাদা সির্কা নিশ্চয়ই পাওয়া যায়? এখানে পাওয়া না গেলেও নেত্রকোনায় তো পাওয়া যাবেই। আপনি নেত্রকোনা থেকে আনিয়ে নেবেন।
ইস্কান্দার আলি মৃদু গলায় বললেন, আম্মাজী, আপনার অনেক মেহেরবানী।
রানু আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। মওলানা সাহেবের খাওয়া দেখতে তার খুবই ভাল লাগছে। সুলতান সাহেব তাকিয়ে আছেন বিরক্ত চোখে। হঠাৎ কেন জানি খুবই বিরক্ত বোধ করছেন। বিরক্তির কারণটা ধরতে পারছেন না। সন্ধ্যার এই সময়টা তিনি বাগানে হাঁটাহাঁটি করেন। মওলানার কারণে হাঁটাহাঁটি করতে পারছেন না– এটাই কি কারণ। তাকে ফেলে রেখে বাগানে চলে যাওয়া যায়। সেটাও ঠিক হবে না। মওলানাকে তিনিই চা খেতে ডেকে এনেছেন। অবশ্যি রানু আছে। মওলানার দায়িত্ব তার উপর দিয়ে চলে যাওয়া যায়। সেটাও বোধ হয় ঠিক হবে না। গ্রামের মানুষরা খুব সুক্ষ্মভাবে কিছু চাল চালে। শহুরে মানুষ সে-সব ধরতে পারে না। তাঁর সহজ-সরল মেয়েকে এসব চাল থেকে দূরে রাখতে হবে।
ভাল-মানুষ ভাবধরা এই মওলানা একটু আগে সুক্ষ্ম চাল চালল। মাহফুজ ছেলেটা একটা খারাপ মেয়ে নিয়ে আসছে সেই মেয়ে থাকবে তাঁর বাড়িতে। ঘটনার বড় অংশই মিথ্যা। তাঁর বাড়িতে মেয়েটার থাকার অংশটা। মাহফুজ কোন বোকা ছেলে না। সে তার বাড়িতে একজনকে রাখবে সেই বিষয়ে আগে কথাবার্তা বলে রাখবে না তা হয় না। তাহলে মওলানা এই মিথ্যা কথাটা কেন বলল?
এই ধরণের মানুষ কথায় কথায় নবীজীর প্রসঙ্গ নিয়ে আসে। তার আদর্শ পালন করার জন্যে ব্যস্ততার সীমা থাকে না। আংগুলে আকিক পাথর পরা, চোখে সুরমা দেয়া এই সব সুন্নত কারণ নবীজী করতেন। আসল সুন্নতের ধারেকাছে কেউ নেই। আসল সুন্নত, তিনি মিথ্যা কথা কখনও বলেন নি।
সুলতান সাহেব থমথমে গলায় বললেন- মওলানা সাহেব, আপনার হাতে কি এটা আকিক পাথর?
ইস্কান্দার আলি বললেন, জ্বি জনাব।
আকিক পাথর কেন পরেছেন?
পাক-কোরানে আকিক পাথরের উল্লেখ আছে জনাব। তার চেয়েও বড় কথা নবীজী সাল্লাললাহু আলায়হে সালাম এই পাথর পরতেন।
ও আচ্ছা।
ইস্কান্দার আলি অস্বস্তি বোধ করছেন। তিনি পরিস্কার বুঝতে পারছেন মানুষটা হঠাৎ রেগে গেছেন। হঠাৎ রাগার কারণটা কী? না-কী মানুষটার স্বভাবই হঠাৎ হঠাৎ রেগে যাওয়া?
জ্বরে অচেতনের মত
০৩.
কে বলবে যে মাহফুজ নামের মানুষটা কিছুক্ষণ আগেও জ্বরে অচেতনের মত হয়েছিল। তার মাথায় খুব কম করে হলেও দশ কলসি পানি চিত্রা নিজে ঢেলেছে। জ্বরের ঘোরে মানুষটা উল্টাপাল্টা কথা বলা শুরু করেছিল। চোখ হয়েছিল পাকা টমেটোর মত লাল।
এখন কি সুন্দর স্বাভাবিক। মাঝির কাছ থেকে নিয়ে পান চিবাচ্ছে। তার পান চাবানো দেখে মনে হচ্ছে খুব মজার পান। মানুষটার চোখের রঙও এখন প্রায় স্বাভাবিক। একটু লালচে আভা আছে। সে থাকাও না থাকার মত। চিত্রা বলল, আপনার শরীর এখন ভাল?
মাহফুজ পানের পিক ফেলতে ফেলতে বলল, ভাল। মাঝে-মধ্যে আমার ভালুক-জ্বর হয়। এই দুই ঘণ্টার জন্যে সব আউলা হয়ে যায়। তারপর সব ঠিকঠাক। সব ফিটফাট।
বলতে বলতে মাহফুজ হাসল। চিত্রা মানুষটার হাসি দেখে মুগ্ধ। এই প্রথম সে হাসল। তার সঙ্গে দেখা হবার পর থেকে চিত্রা তার মুখে হাসি দেখে নি। চিত্রা বলল, আমি আপনার অবস্থা দেখে ভয় পেয়েছিলাম।
তুমি প্রথম দেখছ এই জন্যে ভয় পেয়েছ। কয়েকবার দেখলে ভয় পেতে না।
ডাক্তার দেখিয়েছেন?
আরে দূর, কিসের ডাক্তার। সামান্য জ্বর-জ্বারিতে ডাক্তারের কাছে গেলে রোগ লাই পেয়ে যায়। আরো শক্ত করে চেপে ধরে। অসুখ-বিসুখকে কখনো লাই দিতে নাই। অসুখ-বিসুখ পায়ের নিচে চেপে রাখতে হয়। চল রওয়ানা দেই।
চলুন।
মাহফুজ ব্যাগ হাতে নিল। বাচ্চা একটা ছেলে জোগাড় হয়েছে। তার মাথায় স্যুটকেস। চিত্রা বলল, অনেক দূর হাঁটতে হবে?