রানু বলল, মওলানা সাহেব, আপনি অবশ্যই আরেকদিন আমাদের এখানে ইফতার করবেন এবং রাতে খাবেন। আজ তাড়াহুড়া করে কী করেছি আমার খুবই খারাপ লাগছে।
ইস্কান্দার আলি বললেন, জ্বি আচ্ছা আম্মা। আপনি অনেক ইফতারের ব্যবস্থা করেছেন। অকারণে শরমিন্দা হচ্ছেন। তাছাড়া আম্মা, মানুষের রিজিক আল্লাহপাক নির্ধারণ করে রাখেন। আজ আমি ইফতার কী করব সবই অনেক আগে ঠিক করা। আল্লাহপাক যা যা চেয়েছেন আপনি তাই তৈরি করেছেন। তার বেশিও না, কমও না। মা, ঘরে কি রেডিও আছে?
রানু বরল, জ্বি না। কেন বলুন তো।
আজান শোনার জন্য।
সুলতান সাহেব বললেন, এবারে রেডিও আনা হয় নি। তাড়াহুড়া করে এসেছি।
ইস্কান্দার আলি বললেন, কোন অসুবিধা নাই। অনুমানে রোজা ভাঙব। খালি চোখে যখন গায়ের পশম দেখা যাবে না তখন বুঝতে হবে সূর্য ডুবেছে।
রানু বলল, বা, ইন্টারেস্টিং তো। আমি কিন্তু আমার গায়ের পশম দেখতে পাচ্ছি না। আপনি কি রোজা ভাঙবেন?
ইস্কান্দার আলি বললেন, আম্মা আরেকটু দেখি।
রানু বলল, আপনাকে দেখার এবং আপনার সঙ্গে কথা বলার আমার সখ ছিল। আপনার সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছি।
কি গল্প?
আপনি সারাবছর রোজা রাখেন, সারারাত জেগে ইবাদত করেন।
আম্মা গল্পের মধ্যে মিথ্যা আছে। সত্য গল্পের মধ্যে মানুষ আনন্দ পায় না। এই জন্যে গল্পের মধ্যে মিথ্যা মিশায়। শরীর সুস্থ রাখবার ব্যাপারে আমাদের ধর্ম খুব জোর দিয়েছে। সারারাত ইবাদত বন্দেগী করলে শরীর অসুস্থ হয়ে পড়বে।
আপনি কি আপনার সমস্ত কাজ-কর্ম হাদিস-কোরান দেখে করেন?
জ্বি-না আম্মা, করি না। করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া হাদিস-কোরান তেমন জানিও না।
আমার বাবা কিন্তু খুব ভাল জানেন। তিনি ধর্ম-কর্ম করেন না কিন্তু এই বিষয়ে তাঁর প্রচুর পড়াশোনা।
ইস্কান্দার আলি এক পলক তাকালেন সুলতান সাহেবের দিকে তারপর সাহস করে বলে ফেললেন-যে বিদ্যা কাজে খাটে না সেই বিদ্যার কোন দাম নাই গো আম্মা।
সুলতান সাহেব কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। ইস্কান্দার আলি রোজা ভাঙছেন। সারাদিনের উপবাসী একজন মানুষ আরাম করে খাওয়া-দাওয়া করবে। এই সময়টা তর্ক করে জটিল করা ঠিক না। তাছাড়া তর্ক তার সঙ্গেই করা যায় যে বোঝে। মওলানা সাহেবকে তিনি যদি বলেন কাজে খাটবে না ভেবে কী বিদ্যা অর্জন বন্ধ রাখা যায়? মওলানা কী ব্যাপারটা বোঝবেন? নবীজী বলেছেন-বিদ্যা অর্জনের জন্যে সুদূর চীনে যাও। তিনি তো বলেন নি যে বিদ্যা তুমি কাজে খাটাতে পারবে সেই বিদ্যা অর্জনের জন্য সুদূর চীনে যেও না।
ইস্কান্দার আলি প্রথমেই সবুজ রঙের খাবারটা খাচ্ছেন। টক-মিষ্টি খাবার। বাদামের গন্ধ আসছে। আল্লাহপাকের দুনিয়াতে কত খাবারই না আছে। এই খাবারটার নাম জিজ্ঞেস করাটা কী অভদ্রতা হবে। রানু মেয়েটা হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। ইস্কান্দার আলির মনে হল মেয়েটার আসল নাম রাণী। আদর করে তারা ডাকে রানু। দুটা নামই সুন্দর। বড়ই সুন্দর।
সুলতান সাহেব বললেন, আপনি এ-পর্যন্ত কয়টা রোজা রেখেছেন?
ইস্কান্দার বিনীত ভঙিতে বলল, ইয়াদ নাই জনাব। রোজার হিসাব রাখার চেষ্টাও করি নাই। যার হিসাব তিনি রাখবেন। আমার দরকার ইবাদত করা। নেকি-বদির হিসাব রাখার জন্যে দুই কাঁধে দুই ফিরিশিতা আছে। মানুষের হিসাবে ভুল-ভ্রান্তি হয়, ফিরিশতার হিসাবে হয় না।
সুলতান সাহেব বললেন, আপনি একদিন হাতে সময় নিয়ে আসবেন। ধর্ম নিয়ে আলোচনা করব।
আপনি আসতে বলছেন আমি অবশ্যই আসব। কিন্তু জনাব ধর্ম আলোচনা করতে পারব না। এই বিষয়ে আমার কোন জ্ঞান-বুদ্ধি নাই।
রানু বলল, আমি তো শুনেছি পুরো কোরান শরীফ আপনার মুখস্ত।
ভুল শুনেছেন মা। মুখস্ত করার চেষ্টা করতেছি। হয়েও হয় না। গণ্ডগোল হয়ে যায়। আল্লাহপাক বিশেষ দয়া না করলে কোরান-মজিদ মুখস্ত হবে না। আম্মাজী, এই সবুজ মিষ্টি কি আরেকটু আছে।
জ্বি আছে। আমি নিয়ে আসছি।
মিষ্টিটার নাম কি?
মিষ্টিটার নাম রানু-পছন্দ। আমার আবিষ্কার করা মিষ্টি-এই জন্যে আমার নামে নাম। মিষ্টিটা আপনি ছাড়া আর কেউ এতো পছন্দ করে খায় নি।
আম্মাজী, একেবার বেহেশতী মিষ্টি।
রানু খুশি খুশি মুখে মিষ্টি আনতে গেল। যাবার আগে বলে গেল আপনি ধীরে সুস্থে অন্য খাবারগুলো খান। মিষ্টি তৈরী নেই, বানিয়ে আনতে সামান্য দেরি হবে।
তাহলে থাক।
থাকবে কেন? দশ মিনিটের বেশি লাগবে না।
ইস্কান্দার হঠাৎ খাওয়া বন্ধ করে সুলতান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, জনাব আপনার কন্যা উপস্থিত নাই এই ফাঁকে আপনাকে একটা কথা বলার ইরাদা করেছিলাম। যদি অনুমতি দেন।
সুলতান সাহেব ভুরু কুঁচকে ফেললেন। মওলানা-টাইপ মানুষের বিশেষ কথা মানেই সাহায্য। ভিক্ষা-বৃত্তি। একটা কোন ফাঁক পেলেই এরা অভাব-অনটনের কথা বলবে। সুলতান সাহেব গম্ভীর গলায় বলেন, বলুন কি বলবেন?
মাহফুজ ছেলেটার প্রসঙ্গে একটা কথা।
কি কথা?
সে অতি ভাল ছেলে। মানব-দরদী। তার চিন্তা-ভাবনা সবই অত্যন্ত পরিষ্কার। জগতের নিয়ম হল ভালর হাত ধরে মন্দ ঢুকে।
জগতের নিয়ম বলার দরকার নেই- মাহফুজ সম্পর্কে কি বলতে চাচ্ছেন বলুন।
ছেলেটা খারাপ-পাড়া থেকে একটা মেয়ে নিয়ে গ্রামে আসতাছে। নাটক করবে।
তাতে সমস্যা কি?
জ্বি-না কোন সমস্যা নাই। উদ্দেশ সৎ হলে কোন সমস্যা নাই। কিন্তু জনাব জগতের নিয়ম হল…