সেই নিষিদ্ধ দিনগুলো ছাড়া বাকি দিনগুলোতে রোজা থাকেন?
ইস্কান্দার আলি চুপ করে রইলেন। সুলতান সাহেব বললেন, আজ কি রোজা আছেন?
জ্বি।
আপনার তো ইফতারের সময় হয়ে গেল।
ইস্কান্দার আলি বিনীত ভঙ্গিতে বললেন, কোন সমস্যা নাই। এক গ্লাস পানি দিলেই হবে। পানি দিয়ে রোজা খুলব।
সুলতান সাহেব ব্যস্ত ভঙিতে উঠে ভেতরে চলে গেলেন। ইস্কান্দার আলি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। ইফতার আসবে। বড়লোকের বাড়ির ইফতার অতি উন্নত মানের হবারই কথা। দেখা যাক আল্লাহপাক আজ তার কপালে রিজিক কী রেখেছেন।
ইস্কান্দার আলি মনে মনে ঠিক করে ফেললেন- মাগরেবের আজানটা তিনি এই বাড়ির উঠান থেকেই দেবেন। আজান তো তাকে দিতে হবে। মসজিদ নেই আজানটা তিনি দিবেন কোথায়। সুলতান সাহেব নিশ্চয়ই বলবেন না আপনি আমার বাড়ির উঠানে আজান দিতে পারবেন না। কোনো মুসলমানের পক্ষেই এই কথা বলা সম্ভব না।
সুলতান সাহেব আবার ঢুকলেন। এই বার তাঁর হাতে এসট্রে এবং সিগারেট। তিনি বসতে বসতে বললেন, রানুকে আপনার ইফতার তৈরি করতে বলে এসেছি। রানু আমার বড় মেয়ে। দেখি সে কী করে।
হুমায়ূন আহমেদ ইস্কান্দার আলি বললেন, শুকুর আলহামদুলিল্লাহ।
সুলতান সাহেব বললেন, আজানের এখনো কিছু দেরি আছে। আজকের সূর্যাস্ত ছটা আটে বা দশে। এগজেক্টলি বলতে পারছি না। তিন দিনের আগের পত্রিকা দেখে বলছি।
আপনার মেহেরবাণী।
আমি সিগারেট খেলে কি আপনার অসুবিধা হবে?
জ্বি-না।
আমাদের গ্রাম আপনার কেমন লাগছে?
জ্বি-ভাল। অতি উত্তম।
গ্রামের মানুষরা কেমন?
অতি ভাল। সবাই আমাকে বড় পিয়ার করেন।
এই গ্রামের ছেলে, নাম মাহফুজ তার সঙ্গে কি পরিচয় আছে?
ভাল পরিচয় আছে। বুদ্ধিমান অন্তর পরিষ্কার। অতি উত্তম ছেলে।
যে তিন বারে ইন্টারমিডিয়েট পাস করতে পারে না সে অতি উত্তম হয় কীভাবে? বুদ্ধিমান যে বলছেন, তাকে বুদ্ধিমান তো বলা যায় না। একটা গ্রাম বদলে ফেলবে– স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল বানাবে। পাকা রাস্তা করবে। এ ধরণের অবাস্তব চিন্তা কোন বুদ্ধিমান ছেলে করবে না। কাজ কর্মহীন অলস মানুষ দুধরণের চিন্তা করে হয় অসৎ চিন্তা কিংবা সৎ চিন্তা। ছেলেটা সৎ চিন্তা করছে। তার চিন্তার ধরণ থেকেই বোঝা যায় কাজ কর্মহীন মানুষ।
ইস্কান্দার আলি চুপ করে রইলেন। কারো আলোচনা সমালোচনার সময় চুপ করে থাকাটাই বাঞ্ছনীয়। মনে হচ্ছে সুলতান সাহেব মাহফুজ নামের মানুষটার উপর বিরক্ত হয়েছেন। ইস্কান্দার আলি বিরক্তির কারণটা ধরতে পারছেন না। বিরক্তিটা কোন পর্যায়ের তাও ধরা যাচ্ছে না। মনে হয় খুব বেশি পর্যায়ের। বড় মানুষরা রাগ-বিরক্তি-ভালবাসা-ঘৃণা সবই মাত্রার মধ্যে রাখেন। তারা কখনো মাত্রা অতিক্রম করেন না। এটা ভাল। পাক কোরানে মানুষকে বার বার বলা হয়েছে- সীমা অতিক্রম না করার জন্যে।
মওলানা সাহেব!
জ্বি জনাব।
আমি কাজের মানুষ। আমি কাজ পছন্দ করি। স্বপ্ন বিলাস পছন্দ করি না। স্কুল ফান্ডের জন্যে নাটক হবে। নাটকের জন্যে শহর থেকে নায়িকা আসবে– এইসব খুবই ফালতু ব্যাপার। স্কুলটা সেখানে মূল না। নাটক করাটাই মূল বিষয়। নাটক থিয়েটার নিয়ে কয়েকদিন হৈ চৈ করা।
হৈ চৈ করার দরকার আছে। আনন্দ ফুর্তি সবই প্রয়োজন কিন্তু শিখণ্ডি দাঁড় করানো কেন? স্কুল কলেজ পেছনে রেখে নাটক থিয়েটার কেন? আমি খুবই বিরক্ত হয়েছি। বিরক্তির প্রধান কারণ আমাকে এর সঙ্গে যুক্ত করা। আমি কিছুই জানি না, হঠাৎ দেখি হাতে লেখা পোস্টার টিপু সুলতান নাট্যানুষ্ঠান– আমি প্রধান অতিথি। পোস্টারে দুটা বানান ভুল। আমি এসেছি রানুকে নিয়ে কয়েকটা দিন নিরিবিলি সময় কাটাতে, এর মধ্যে একি উপদ্রব!
.
ইস্কান্দার আলির মনে হল এই মানুষটার বিরক্তি সহজ পর্যায়ের না, জটিল পর্যায়ের। বিরক্ত মানুষের সামনে বেশিক্ষণ বসে থাকা ঠিক না, কারণ বিরক্তি যে-কোন সময় দিক বদলায়। একজনের বিরক্তি অন্য জনের উপর চলে আসে। মাহফুজের উপর বিরক্তিটা হঠাৎ তার উপর এসে পড়তে পারে। ভালবাসা বা রাগের ক্ষেত্রে এরকম ঘটে না। এক জনের ভালবাসা আরেক দিকে যায় না, বা এক জনের রাগ অন্যজনের দিকে যায় না।
রানু ট্রে ভর্তি খাবার নিয়ে ঢুকল। ইস্কান্দার আলি হতভম্ব হয়ে গেলেন। তার মনে হল দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের জীবনে তিনি এমন রূপবতী তরুণী দেখেন নি। বেহেশতবাসী প্রত্যেককে সেবার জন্যে সাতটা করে হুর দেয়া হবে। ইস্কান্দার আলির মনে হল সেই সাতটা হুরের কোনটাই এই মেয়ের পায়ের কড়ে আঙ্গুলের নখের কাছে যেতে পারবে না। এক দৃষ্টিতে কোন তরুণী মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকা নিতান্তই অভদ্রতা, কিন্তু ইস্কান্দার আলি চোখ ফিরিয়ে নিতে পারছেন না। রানু ইস্কান্দার আলির দিকে তাকিয়ে বলল, চাচা স্লামালিকুম।
ইস্কান্দার আলি হড়বড় করে বললেন, ওয়ালাইকুম সালাম মা। ওয়ালাইকুম সালাম ওয়া রহমতুল্লাহ।
ইস্কান্দার আলি তার দৃষ্টি মেয়েটির হাতের ট্রের দিকে নিয়ে গেলেন। অতি অল্প সময়ে সে অনেক আয়োজন করেছে। লেবুর সরবত, সমুচা, গোশত পরাটা, আরেকটা বাটিতে সবুজ রঙের কী-যেন দেখা যাচ্ছে। শহুরে কোন খাবার বোধ হয়। মিষ্টি জাতীয় কী-না কে জানে। ইফতারের মিষ্টি জাতীয় কিছু থাকা দরকার। নবীজীর সুন্নত। নবীজীর মতো হওয়া তো সম্ভব না। তাঁর দুএকটা কাজকর্ম অনুসরণ করার সামান্য চেষ্টা।