সুলতান সাহেব গ্রামের এসেছেন এই খবর তিনি পেয়েছেন। অসম্ভব মানী একজন মানুষ তাঁর ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে কয়েকদিন থাকতে এসেছেন। মওলানা ইস্কান্দার আলির উচিত ছিল তাঁর সঙ্গে দেখা করে আসা। উচিত কাজটি করা হয় নি।
মানী লোককে সম্মান দিতে হয়। এও হাদিসের উপদেশ। মানী, জ্ঞানী এবং গুণী এই তিন সব সময় সম্মান পাবে। কারণ মান, জ্ঞান এবং গুণ আল্লাহপাকের পুরষ্কার। আল্লাহপাক নিজে যাকে পুরষ্কার দিয়েছেন– সাধারণ মানুষ তাকে সম্মান দিবে না কেন?
কেমন আছেন মওলানা সাহেব।
জ্বি ভাল আছি। আপনাকে সালাম দিতে ভুলে গিয়েছি– এই বেয়াদবী ক্ষমা করে দিবেন। আসোলামু আলায়কুম।
ওয়ালাইকুম সালাম।
আপনার কথা শুনেছি। আপনাকে দেখার শখ ছিল।
জনাব, আমি খুবই নাদান মানুষ। ঝড়ের পর গ্রামের অবস্থা দেখতে বের হয়েছি। ক্ষয় ক্ষতিটা দেখি ভালই হয়েছে। শুনলাম মসজিদ ভেঙে পড়ে গেছে।
জ্বি জনাব।
মসজিদ ভেঙে পড়ে গেছে শুনে খুবই খারাপ লাগছে– এত দিনের পুরনো মসজিদ। কত ইতিহাস এর সঙ্গে জড়িত ছিল। আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম আর্কিওলজি বিভাগকে মসজিদটার ব্যাপারে উৎসাহী করতে। সম্ভব হয় নি। এই মসজিদের সবচে ইন্টারেস্টিং ব্যাপারটা কী আপনি লক্ষ্য করেছেন?
ইস্কান্দার আলি বললেন, কোন ব্যাপারটার কথা বলছেন বুঝতে পারছি না।
ইমাম যে জায়গায় দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ান সেই জায়গাটাকে কি বলে? মনে হয় মিম্বর। এই মসজিদে এ রকম দুটা জায়গা। পাশাপাশি। দুজন ইমাম তো নিশ্চয়ই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নামাজ পড়াবেন না। তাহলে দুটা জায়গা কেন? নিশ্চয়ই এর পেছনে ইতিহাস আছে। ইতিহাসটা কি? …
ব্যাপারটা ইস্কান্দার আলি লক্ষ্য করেছেন। মাথা ঘামান নি। এখন মনে হচ্ছে মাথা ঘামানোর দরকার ছিল। ইফতারের সময় প্রায় হয়ে এসেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলে সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না। একজন মানী লোক কথা বলছেন ফট করে তার মুখের উপর বলা যায় না– জনাব আমি যাই। মাগরেবের আজান দেয়া দরকার। আজানটা তিনি কোথায় দেবেন। জামাতে নামাজ পড়তে যদি কেউ আসে তারা কোথায় নামাজ পড়বে?
মওলানা সাহেব!
জ্বি।
চলুন আমার সঙ্গে চা খাবেন।
জ্বি আচ্ছা জনাব। বহুত শুকরিয়া।
মওলানা সুলতান সাহেবের পেছনে হাঁটছেন। তাঁর কাছে সুলতান সাহেব মানুষটাকে অস্থির প্রকৃতির বলে মনে হচ্ছে। অতি দ্রুত হাঁটছেন। অস্থির প্রকৃতির মানুষ দ্রুত হাঁটে। অস্থির প্রকৃতির মানুষ কথাও বেশি বলে। হড়বড় করে কথা বলতে থাকে। তবে মানুষটার অহংকার মনে হয় কম। এত বড় মাপের মানুষ বাংলাদেশ সরকারের একজন রাষ্ট্রদূত। আগে ছিলেন বার্মার রাষ্ট্রদূত, এখন সম্ভবত নেপালের। মানুষটা হাঁটছেন লুঙ্গি পরে। গায়ে সৃতির পাঞ্জাবী। তার মত সামান্য মানুষকে প্রথম দেখাতেই চা খাবার দাওয়াত করে নিয়ে যাচ্ছেন।
মওলানা সাহেব।
জ্বি।
.
ইস্কান্দার আলি সুলতান সাহেবের বারান্দায় বসে আছেন। সুলতান সাহেব ভেতরে গিয়েছেন খুব সম্ভব চায়ের কথা বলতে। ইস্কান্দার আলি একটু চিন্তিত বোধ করছেন। চা আনতে আনতে রোজা খোলার সময় হয়ে যাবে না তো। শুধু চা নিশ্চয়ই আসবে না। চায়ের সঙ্গে নাশতা থাকবে। পানি থাকবে। ইস্কান্দার আলির সঙ্গে ঘড়ি নেই। মাগরেবের ওয়াক্ত বোঝার জন্য তাকে প্রকৃতির উপর নির্ভর করতে হয়। আজ আকাশ ঘোলা। সূর্য ডোবার ঠিক সময়টা ধরা মুশকিল। এই বাড়িতে হাঁস-মুরগি থাকলে ভাল হত। হাঁস-মুরগি সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ঘরে ঢুকে যায়। মোগর বাগ দেয় সূর্য ওঠার সময়। তবে আজকাল বোধ হয় নিয়ম পাল্টে গেছে। তাঁর নিজের বাড়িতে একটা মোরগ ছিল রাত দুটা আড়াইটার দিকে বাগ দিয়ে সবার ঘুম ভাঙ্গাতো।
সুলতান সাহেবের বাড়ির বারান্দাটা ভাল। সামনেই বাগানের মত আছে। দেশী ফুলের বাগান। একটা জবা ফুলেরগাছ জবা ফুলে লাল টুকটুকে হয়ে আছে। জবা হিন্দুদের পূজায় লাগে। মুসলমান বাড়িতে এই ফুলের গাছ থাকা ঠিক না। মানুষ এবং জ্বীনের ভেতর যেমন হিন্দু মুসলমান আছে, গাছপালার মধ্যেও আছে। জবা তুলসি এইগুলা হিন্দু গাছ। নারিকেল-সুপারি মুসলমান গাছ। বাতাসের সময় এরা সিজদার মত নিচু হয় বলেই মুসলমান।
চারদিক পরিষ্কার ঝকঝক করছে। ঝড়ের কারণে শুকনো পাতা পড়ে থাকার কথা। একটা শুকনো পাতাও নেই। মনে হয় ঝট দেয়া হয়েছে। সুলতান সাহেবের বাড়িটা পাকা। এই গ্রামের তিনটা পাকা বাড়ির মধ্যে সুলতান সাহেবের বাড়িটা সবচেয়ে সুন্দর। সুন্দর বাড়ি আল্লাহর রহমত স্বরূপ। এই মানুষটার উপর আল্লাহর রহমত আছে।
ইস্কান্দার সাহেব খুবই অবাক হয়ে দেখলেন সুলতান সাহেব দুহাতে দুটা চায়ের কাপ নিয়ে নিজেই বারান্দায় এলেন। চায়ের সঙ্গে আর কিছু নেই। অথচ রোজা খোলার সময় হয়ে গিয়েছে বলে তার ধারণা।
সুলতান সাহেব বললেন, আমি বৃহস্পতিবার পর্যন্ত আছি। এর মধ্যে কোন এক রাতে এসে আমার সঙ্গে ডিনার করবেন। আমার বড় মেয়ে আপনার সঙ্গে গল্প করতে চায়।
ইস্কান্দার আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, কেন?
জানি না কেন। আপনার সম্পর্কে নানান গল্প-গুজব শুনেছে। আপনি নাকি সারা বছর রোজা রাখেন। সত্যি না-কি?
জ্বি না, সত্যি না। বছরে অনেক দিন আছে রোজা রাখা নিষিদ্ধ।