ভদ্রলোক একটু থামতেই হঠাৎ করে হাততালি শুরু হয়ে গেল। হাততালি থামার পর বয়স্ক মানুষটি বললেন, “টিম মিরূসোরাস, তোমরা মঞ্চে এসে তোমাদের প্রথম পুরস্কার নিয়ে যাও।”
সঞ্জয় তখন প্রথমবার বুঝতে পারল তারা পুরস্কার পেয়েছে। তখন সে একটা গগনবিদারী চিৎকার দিল, তারপর স্টেজের দিকে ছুটতে লাগল। দর্শকদের ভেতর থেকে রাজু ছুটে এলো, বারান্দা থেকে মিম্মি এবং সবার শেষে রূপা। প্রধান অতিথি তাদের গলায় মেডেল ঝুলিয়ে দিলেন এবং তখন হঠাৎ রূপা আবিষ্কার করল আম্মু তার জায়গা থেকে উঠে ছুটতে ছুটতে স্টেজের সামনে চলে এসেছেন, হাতে তার মোবাইল ফোন যেটা দিয়ে ছবি তোলা যায়। আম্মুর ছবি তুলতে অনেক সময় লাগল, যতক্ষণ ছবি তোলা শেষ না হল প্রধান অতিথি ততক্ষণ মেডেলটা রূপার গলায় ঝোলানোর ভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
ছবি ভোলা শেষ হবার পর আম্মু রূপার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেললেন আর রূপা হঠাৎ করে আবিষ্কার করল, আম্মুর চেহারা খুব সুন্দর, হাসলে আম্মুকে কী সুন্দরই না দেখায়।
.
১৬.
দরজায় শব্দ শুনে রূপা গিয়ে দরজা খুলে দিল। মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে টিশটাশ একজন সুন্দরী মহিলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রূপা মহিলাকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল তখন টিশটাশ সুন্দরী মহিলাটি হি হি করে হেসে ফেলল। বলল, “রূপ-রূপালী, আমাকে চিন না?”
রূপা তখন অবাক হয়ে চিৎকার করে বলল, “সুলতানা! তুমি?”
“হ্যাঁ, আমি! কী হল? আমারে ঢুকতে দিবা না?”
“তোমাকে কী সুন্দর লাগছে সুলতানা! আমি চিনতেই পারিনি!”
সুলতানা তার সেই ময়লা কামিজ পরেনি। সে সুন্দর একটা সুতির শাড়ি পরেছে। মাথার চুলগুলো তেল চিটচিটে হয়ে নেতিয়ে নেই। সুন্দর হয়ে ফুলে আছে। কপালে টিপ আর ঠোঁটে খুব হালকা লিপস্টিক। কাঁধ থেকে একটা আধুনিক হ্যান্ডব্যাগ ঝুলছে। দুই হাতে কাঁচের চুড়ি, গলায় সরু একটা নেকলেস। সুলতানাকে মনে হয় কোনোদিন রূপা ভালো করে দেখেনি। সে যে এত সুন্দর সে কখনো কল্পনা করেনি। শুধু যে দেখতে সুন্দর হয়েছে তা না, কথাও বলে সুন্দর করে। এই প্রথমবার রূফ-রূফালী না বলে রূপ-রূপালী বলছে! রূপা গিয়ে সুলতানাকে জড়িয়ে ধরল, বলল, “তুমি আমাদেরকে ভুলেই গেছ।”
সুলতানা বলল, “না ভুলি নাই। রূপ-রূপালী আমি তোমাকে একটুও ভুলি নাই। খালাম্মা কই?”
“ভেতরে।”
“আমার উপরে অনেক রাগ?”
রূপা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ।”
“দেখি রাগ ভাঙানো যায় কী না” বলে সুলতানা বাসার ভেতরে ঢুকল।
রূপা যে রকম প্রথমে সুলতানাকে চিনতে পারেনি আম্মুও ঠিক সেরকম সুলতানাকে চিনতে পারলেন না। সুলতানা ডাইনিং টেবিলে মিষ্টির প্যাকেটটা রেখে রান্নাঘরে গিয়ে আম্মুর পায়ে ধরে সালাম করে যখন বলল, “খালাম্মা, আপনার শরীরটা ভালো?” তখন আম্মু সুলতানাকে চিনতে পারলেন। অবাক হয়ে বললেন, “সুলতানা? তুই!”
“জি খালাম্মা। আপনার শরীর ভালো?”
“আর আমার শরীর! আমার শরীর নিয়ে কার ঘুম নষ্ট হয়েছে?”
আম্মু হাতে চাকু নিয়ে পেঁয়াজ কাটছিলেন, রূপা আম্মুর হাত থেকে চাকুটা টেনে নিয়ে বলল, “খালাম্মা আপনি বিশ্রাম নেন। আমি রেন্ধে দেই।”
“তুই বেঁধে দিবি? এই রকম সেজেগুঁজে রাধা যায় না কি?”
“যায় খালাম্মা।” বলে সুলতানা শাড়ির আঁচলটা কোমরে পেঁচিয়ে নিল। মাথার চুলগুলো মাথার উপরে ঝুঁটির মতো করে খোঁপা করে নিল। হাতের চুড়িগুলো টেনে উপরে নিয়ে আটকে দিয়ে দক্ষ হাতে পেঁয়াজ কাটতে লাগল।
আম্মু কী করবেন বুঝতে না পেরে একটা ডেকচি একটু ধুতে যাচ্ছিলেন, সুলতানা হা হা করে উঠল, বলল, “যান খালাম্মা, যান! আপনার ডেকচি ধুতে হবে না।”
আম্মু বললেন, “আমি কি বাসন ধুই না?”
“কিন্তু আমি যতক্ষণ আছি আপনাকে ধুতে হবে না। আমি ধুয়ে দেব। যান আপনি।”
আম্মু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে একটা নিশ্বাস ফেললেন, বললেন, “তোর কাজকর্ম তা হলে ভালোই হচ্ছে?”
“এই এক রকম।”
“দেখে তো ভালোই মনে হচ্ছে।”
“ভালো আর কী খালাম্মা। আপনারা আমার জন্যে যেই রকম দোয়া করবেন আমি সেই রকম থাকব।”
সুলতানা পেঁয়াজ কেটে সরিয়ে রেখে আম্মুকে জিজ্ঞেস করল, “কী খাবেন আজকে খালাম্মা? ফ্রিজে মুরগি আছে? আলু দিয়ে রেন্ধে দেই?”
“রাধবি?”
“আপনি যদি বলেন।” সুলতানা চোখ বড় বড় করে বলল, “সাথে ভাত না রেন্ধে একটু পোলাও করে দেব? ছুটির দিনে সবাই খাবেন?”
আম্মু বললেন, “ঠিক আছে। সাথে সবজি–”
সুলতানা বলল, “যান খালাম্মা, আপনি বিশ্রাম নেন, কী রান্ধতে হবে আমার হাতে ছেড়ে দেন। আমি দেখি কী আছে।”
আম্মুকে রান্নাঘর থেকে সরিয়ে দিয়ে সুলতানা রান্না শুরু করে দিল। সুলতানা এসেছে শুনে তিয়াশা আর মিঠুনও রান্নাঘরে তাকে দেখতে এলো। মিঠুন বলল, “সুলতানা আপু তোমাকে দেখে এখন অন্যরকম লাগছে! মনে হচ্ছে তুমি কলেজে পড়!”
সুলতানা হি হি করে হেসে বলল, “তা হলে কী আমি এখন তোমার সাথে ইংরেজিতে কথা বলব? কামিং গোয়িং ইটিশ মিটিশ?”
মিঠুন বলল, “তুমি খুবই ফানি সুলতানা আপু!”
.
যখন রান্নাঘরে কেউ নেই তখন গুটিগুটি পায়ে রূপা সেখানে হাজির হল। রূপাকে দেখে সুলতানা দাঁত বের করে হাসল, গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, “রূপ রূপালী, কী মনে হয় খালাম্মার রাগ কি একটু কমেছে?”