রূপা মাথা নাড়ল, বলল, “না, পারব না।”
“ঠিক আছে আমি তোমাকে সাহায্য করি। সূর্যের আলো থেকে রাফলি প্রতি বর্গমিটারে একশ বিশ ওয়াট এনার্জি আসে। আর প্রতি সি এফ টি গ্যাস থেকে তাপ তৈরি হয় আনুমানিক এক মেগাজুল। এখন তুমি আমাকে বলো তোমার আইডিয়া দিয়ে তুমি দেশের কত সম্পদ রক্ষা করতে পারবে?”
রূপা মাথা নিচু করে বলল, “পারব না স্যার।”
“পারবে না কেন? নিশ্চয়ই পারবে। বলো।”
রূপা দাঁড়িয়ে রইল, আর তখন বয়স্ক মানুষটার একটু মায়া হল। তাই তাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, “ঠিক আছে তুমি পারলে বের কর। আমি যাবার সময় দেখব তুমি পেরেছ কী না।”
তিনজনের বিচারকের টিম তখন পাশের টেবিলে গেলেন অদৃশ্য আলো দেখার জন্যে। সায়েন্স ম্যাডাম টিমের সাথে আছেন। কিন্তু নিজ থেকে একটা কথাও বলছেন না।
বিচারকের দলটা বেশ খানিকটা দূর চলে যাবার পর রূপা হঠাৎ করে বুঝতে পারল বয়স্ক মানুষটা তার কাছে কী জানতে চেয়েছেন–আসলেই তো কঠিন কিছু জানতে চাননি, বেশ সোজা একটা জিনিস জানতে চেয়েছেন। সারাদিন যদি কেউ একটা পানির গামলায় সূর্যের আলো ফেলে পানি গরম করে তা হলে কত সি এফ টি গ্যাস বাঁচানো যাবে। রূপা তখন একটা কাগজে হিসাব করতে বসল। বাংলাদশে সোল কোটি মানুষ, যদি পাঁচজনের একটা পরিবার হয় তা হলে প্রায় তিন কোটি পরিবার। প্রত্যেকটা পরিবার যদি এক স্কয়ার মিটারের এক গামলা পানি রোদে রেখে দেয় তা হলে সারাদিনে সেই পানি কতটুকু গরম হবে। যদি গ্যাস জ্বালিয়ে সেই পরিমাণ তাপ তৈরি করতে হয় তা হলে কত গ্যাস লাগবে। ক্যালকুলেটর নেই তাই কাগজে লিখে অনেক গুণ, ভাগ করতে হল এবং তার উত্তর হল বছরে পঞ্চাশ বিলিওন সি এফ টি! হিসাবে কোথাও নিশ্চয়ই গোলমাল করেছে তাই আরেকবার হিসাব করল তারপরও একই উত্তর। তা হলে কী আসলেই পঞ্চাশ বিলিওন সি এফ টি গ্যাস? সেটা তো অসম্ভব একটা ব্যাপার। রূপা আরো একবার হিসাব করল একই উত্তর এলো। কী আশ্চর্য!
বিচারকের দলটা যাবার আগে সত্যি সত্যি তার কাছে আরো একবার এলো। বয়স্ক মানুষটা রূপাকে জিজ্ঞেস করলেন, “বের করেছ?”
রূপা মাথা চুলকে বলল, “বের করেছি, কিন্তু মনে হয় উত্তরটা ভুল।”
“কেন?”
“আমার উত্তর এসেছে বছরে পঞ্চাশ বিলিওন সি এফ টি গ্যাস বাঁচানো যাবে!”
ভদ্রলোক শিস দেবার মতো শব্দ করে হেসে ফেললেন, তারপর বললেন, “কেমন করে বের করেছ?”
“ধরেছি পাঁচজন করে ফ্যামিলি, বাংলাদেশে মোট ফ্যামিলি প্রায় তিন কোটি। সবাই সূর্যের আলো দিয়ে দিনে বারো ঘণ্টা এক মিটার স্কয়্যারের গামলায় পানি গরম করে। সেভাবে ধরলে–”
বয়স্ক ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, বললেন, “বুঝেছি।” বিচারকের দলটি হেঁটে চলে যেতে যেতে থেমে গেলেন, রূপার দিকে তাকিয়ে বললেন, আচ্ছা, “তোমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় তোমার এই আইডিয়াটার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক কী তুমি কী বলবে?”
রূপা মাথা চুলকাল তারপর বলল, “এইটা খুবই সোজা। সত্যি সত্যি যে কোনো মানুষ এটা করতে পারবে। একটা চাড়ি কিনে পানি ভরে বাইরে ফেলে রাখবে। রান্না করার সময় এখান থেকে পানি নিয়ে রান্না করবে!”
ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন তারপর হেসে ফেললেন। তারপর দল নিয়ে চলে গেলেন। রূপার আম্মু তার মাঝে যে তেতো একটা লজ্জা আর অপমানের ভাব দিয়ে গিয়েছিলেন, বয়স্ক ভদ্রলোকের হাসিটুকু দিয়ে তার অনেকটুকু দূর হয়ে গেল। পুরস্কার সে না পেতে পারে কিন্তু অপমানিত তো হতে হল না!
.
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম স্কুল বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং আরো অনেক বুড়ো বুড়ো মানুষ স্টেজে বসে রইল। টেবিলে অনেকগুলো মেডেল সাজানো-কারা কারা সেটা পাবে সবাই এর মাঝে অনুমান করে ফেলেছে। পুরস্কার দেবার আগে বক্তৃতা শুরু হল এবং লম্বা লম্বা বক্তৃতা শুনে সবার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা। রূপা ফিসফিস করে মিম্মিকে বলল, “আয় পালাই।”
মিম্মি বলল, “চল।”
দর্শকদের সাথে আম্মুও বসে আছেন, কাজেই আম্মুর চোখ এড়িয়ে রূপা হলঘর থেকে বের হয়ে এলো। রূপার পিছু পিছু মিম্মি এবং সবার শেষে সঞ্জয়। তিনজন বারান্দায় খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করল, সঞ্জয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ইশ! আমরা ফার্স্ট প্রাইজটা মিস করলাম।”
রূপা বলল, “তুই কেমন করে জানিস?”
সঞ্জয় বলল, “আমি জানি।”
“ঠিক আছে তা হলে পরের বার।”
তিনজন হলঘরের বারান্দার এই মাথা থেকে ঐ মাথা পর্যন্ত একবার হেঁটে আসে। ভেতরে বক্তৃতা শেষ, এখন মনে হয় পুরস্কার দেওয়া শুরু হবে। রূপা মিম্মিকে জিজ্ঞেস করল, “সোহেলের কোনো খবর জানিস?”
“মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি হয়েছে।”
“কতদিন লাগবে?”
“অনেকদিন। আর মজা কী হয়েছে জানিস?”
“কী?”
“এই গোলমালের কারণে সোহেলের আব্বু-আম্মুর মিলমিশ হয়ে গেছে।“
”সত্যি?”
“সত্যি!”
ঠিক এরকম সময়ে হলঘরের ভেতর থেকে একটা বিস্ময়ের মতো শব্দ শোনা গেল। মনে হল সব ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবক অবাক হয়ে একটা নিশ্বাস ফেলেছে। রূপা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
মিম্মি বলল, “নিশ্চয়ই কেউ স্টেজ থেকে আছাড় খেয়ে পড়ে গেছে!”
কে আছাড় খেয়ে পড়েছে সেটা দেখার জন্যে তারা তিনজন তখন হলঘরের একটা দরজা দিয়ে উঁকি দিল। মঞ্চে ডায়াসের সামনে বিচারকদের মাঝে বয়স্ক মানুষটি ডায়াসের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। রূপা শুনল মানুষটি বলছেন, “আমি জানি তোমাদের মনে হতে পারে একটা কাগজে দুই লাইন কথা লিখে একটা টিম কেমন করে সায়েন্স ফেয়ারে ফাস্ট প্রাইজ পেতে পারে! কিন্তু তোমরা বিশ্বাস কর এই দুটি লাইন কিন্তু অসাধারণ একটা আইডিয়া। এটা বাস্তবে করা সম্ভব এবং দেশের কোটি কোটি টাকার জ্বালানি বাঁচানো সম্ভব। ছোট মেয়েটি প্রায় নিখুঁতভাবে হিসাব করে আমাকে এটা দেখিয়েছে এবং আমি এনজিও ফোরামে গিয়ে বলব তারা যেন গ্রামে গ্রামে এই আইডিয়াটা ছড়িয়ে দেয়–