”হ্যাঁ।”
“কীভাবে করা হবে?”
“প্রত্যেকটা বাসায় একটা পানির গামলা থাকবে, সেই গামলায় পানি ভরে রোদে রেখে দেবে। একটা প্লাস্টিকের ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দেবে, যেন তাপ বের হতে না পারে। রান্না করার সময় সেখান থেকে পানি নিয়ে রান্না করবে।”
সঞ্জয় হাত নেড়ে উড়িয়ে দিয়ে বলল, “ধুর! রান্নাবান্না আবার সায়েন্স প্রজেক্ট হল না কি?”
রূপা রেগে গিয়ে বলল, “গাধা, এটা রান্নাবান্না না। এটা হচ্ছে জ্বালানি বাঁচানো। শুধু জ্বালানি বাঁচবে না গ্রিন হাউস গ্যাসও কম বের হবে। পরিবেশের জন্যে ভালো–”
“ধুর!” সঞ্জয় বলল, “এর থেকে টাইম মেশিন ভালো।”
মিম্মি বলল, “না হয় ব্ল্যাক হোল!”
রাজু মাথা চুলকে বলল, “টাইম মেশিন আর ব্ল্যাক হোল তো আমরা বানাতে পারব না। রূপার আইডিয়াটা তো কাজে লাগানো যাবে।”
“কিন্তু খুবই বোরিং।” মিম্মি হতাশ ভঙ্গিতে বলল, “কেউ শুনবেই না।”
রূপা বলল, “না শুনলে নাই। আমি এটাই বলব।”
.
কাজেই দেখা গেল সবাই তাদের টেবিলে নানা ধরনের মজার মজার সায়েন্স প্রজেক্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মিরূসোরাস টিমের টেবিল খালি। শুধু পিছনে একটা কাগজে লেখা :
জ্বালানি সাশ্রয় এবং গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন থেকে
রক্ষার সহজ পন্থা : সূর্যের আলো দিয়ে পানি গরম
করে সেই পানি রান্নার কাজে ব্যবহার করা।
তাদের সেই লেখাটি কেউ পড়েও দেখল না, সবাই আশেপাশের বিজ্ঞান প্রজেক্ট দেখতে লাগল। মাসুক রোবট সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটা সবচেয়ে বেশি ভিড় জমিয়ে ফেলল। ইলেকট্রিক বেল, অদৃশ্য আলো, মানুষের পরিপাকতন্ত্র, রঙের মিশ্রণ–এরকম মজার মজার এক্সপেরিমেন্ট ছেড়ে কে তাদের বক্তৃতা শুনতে আসবে? কাজেই তাদের টিম থেকে প্রথমে মিম্মি তারপর সঞ্জয় খসে পড়ল। রাজু হয়তো আরো কিছুক্ষণ থাকত কিন্তু ভলান্টিয়ার কম পড়ে গেল বলে ম্যাডাম তাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। কাজেই রূপা একা তার পোস্টারের সামনে দাঁড়িয়ে রইল, কেউ তার কাছে কিছু শুনতে এলো না। ছেলেমেয়েদের আব্বু আম্মুরা এসেছে তারা ঘুরে ঘুরে প্রজেক্টগুলো দেখছে কেউ তার টেবিলের সামনে দাঁড়াল না।
শুধু আম্মু তার টেবিলের সামনে দাঁড়ালেন, সরু চোখে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “এইটা তোর প্রজেক্ট?”
রূপা লজ্জায় লাল-বেগুনি হয়ে বলল, “হ্যাঁ।”
“একটা কাগজে দুই-তিনটা লাইন লিখে টানিয়ে রেখেছিস?”
“আসলে এইটা একটা আইডিয়া।”
“এইটা আইডিয়া?”
রূপা মাথা নাড়ল। আম্মু গলা নামিয়ে বললেন, “গাধামোর তো একটা সীমা থাকা দরকার। সবাই কত সুন্দর সুন্দর প্রজেক্ট করেছে আর তুই একটা কাগজে ফালতু একটা কথা লিখে বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে আছিস? কেউ ঘুরেও তাকাচ্ছে না। লজ্জা করে না তোর?”
রূপা কী বলবে বুঝতে পারল না, সত্যিই তো, কেউই তার কাছে আসেনি। সত্যিই তো সে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে। আম্মু চলে যেতে যেতে আবার ফিরে এলেন, “তুই সারাক্ষণ বলিস না যে সায়েন্স গ্রুপে পড়বি? সেই জন্যে আমি আজকে এসেছি দেখতে। কারা সায়েন্স গ্রুপে পড়বে জানিস?” আম্মু আশেপাশের সবাইকে দেখিয়ে বললেন, “ওরা! তুই না। তুই সায়েন্সের ‘স’ও জানিস না।”
বলে আম্মু গট গট হেঁটে চলে গেলেন। রূপার মনে হল তার চোখ ফেটে পানি বের হয়ে আসবে। পৃথিবীতে তার আম্মুর থেকে নিষ্ঠুর কোনো মানুষ কী আছে? রূপা তখনই তার পোস্টারটা টেনে ছিঁড়ে চলে যেত কিন্তু যেতে পারল না তার কারণ বিজ্ঞান ম্যাডামের সাথে তিন-চারজন মানুষ ঠিক তখন হাতে কাগজ কলম নিয়ে তার টেবিলের সামনে দাঁড়ালেন। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বয়স্ক মানুষটা তার পোস্টারে লেখা কাগজটার লেখাগুলো পড়ে বলল, “ইন্টারেস্টিং! তোমার প্রজেক্ট হচ্ছে এই স্টেটমেন্ট?”
রূপা লজ্জায় লাল হয়ে গেল, বলল, “আসলে আমাদের আরেকটা প্রজেক্ট ছিল, সেটা শেষ হয়ে গেছে তাই-”
পিছনের মানুষটা বলল, “এটাতে তো দেখার কিছু নেই। আমরা গ্রেড দিব কীসে?”
রূপা বুঝতে পারল এরা হচ্ছে বিচারক, বাইরে থেকে এসেছেন। সবার প্রজেক্টে নম্বর দিতে দিতে যাচ্ছেন। তাকে কত নম্বর দেবেন? শূন্য? না কী শূন্য থেকেও কম, নেগেটিভ নম্বর?
মানুষগুলো চলে যাবার জন্যে রূপা দাঁড়িয়ে রইল। পিছনের দুইজন চলেও যাচ্ছিল কিন্তু বয়স্ক মানুষটা দাঁড়িয়ে কী যেন চিন্তা করল তারপর রূপাকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার এটা তো বিজ্ঞানের প্রজেক্ট হয় নাই।”
রূপা মাথা নিচু করে বলল, “জানি। আসলে আমাদের আসল যে প্রজেক্ট ছিল–”
বয়স্ক মানুষটা বাধা দিয়ে বলল, “না না, আমি সেটা বলছি না। তুমি যদি দাবি কর একটা আইডিয়া দিয়ে জ্বালানি কিংবা গ্রিন হাউস গ্যাস কমানো সম্ভব তা হলে তোমাকে একটা সংখ্যা বলতে হবে। বল, কতখানি জ্বালানি বাঁচাবে?”
রূপা মাথা নাড়ল, বলল, “ইয়ে-জানি না।”
“তা হলে তো হবে না। আমিও তো একটা আইডিয়া দিতে পারি, বলতে পারি মোবাইল ফোনে কথা না বললে ব্যাটারি চার্জ করতে হবে না। আর ব্যাটারি চার্জ করতে না হলে অনেক ইলেকট্রিসিটি বাঁচবে। দেশের উপকার হবে। বলতে পারি না?”
“জি। পারেন।”
“কিন্তু আমি যদি সংখ্যা দিয়ে দেখাতে না পারি তা হলে তো আমার কথার কোনো গুরুত্ব নাই। কাজেই তোমার এই আইডিয়াটা আসলেই ঠিক না ভুল যদি আমাকে জানতে হয় তা হলে তোমাকে কোনো সংখ্যা দিয়ে বলতে হবে। বলতে পারবে?”