সে চোখ মুছতে মুছতে অ্যাসেম্বলির জন্যে এগিয়ে যায়।
অ্যাসেম্বলি শেষে ক্লাশে ফিরে এসে রূপা তার জায়গায় বসল। তার বামদিকে বসেছে লিজা, ক্লাশের সবচেয়ে সুন্দরী এবং সবচেয়ে অহংকারী মেয়ে। এই মেয়েটি একবারও ভুলতে পারে না যে তার চেহারা ভালো, সারাক্ষণই সে তার চেহারা নিয়ে কিছু না কিছু করছে। সে যখন কথা বলে বা হাসে তার মাঝেও একটা ঢং ঢং ভাব থাকে, স্বাভাবিক ভঙ্গিতে লিজা কিছু করতেই পারে না। তার ডান পাশে বসেছে রাজু–চুপচাপ নিরীহ ধরনের ছেলে। ছোটখাট সাইজ, চোখে বড় চশমা। চেহারাটা একেবারে সাধারণ একটা ছেলের মতো, দেখলে কখনোই আলাদাভাবে চোখ পড়ে না। বেশ অনেকদিন রাজু তাদের ক্লাসে আছে রূপা এখনো ভালো করে বুঝতে পারে না ছেলেটা কী লেখাপড়ায় ভালো না খারাপ। ক্লাশে স্যার-ম্যাডামেরা যখন প্রশ্ন করেন তখন কখনো সে হাত তুলে প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করে না। মনে হতে পারে সে বুঝি উত্তর জানে না–কিন্তু কখনো যদি তাকে কিছু জিজ্ঞেস করা হয় সে আস্তে আস্তে ইতস্তত করে ঠিক ঠিক উত্তর দিয়ে দেয়! যে একটা প্রশ্নের উত্তর জানে সে কেন হাত তুলে সেটা বলার চেষ্টা করবে না রূপা এখনো বুঝতে পারে না।
প্রথম পিরিওডে জ্যামিতি ক্লাশ। জ্যামিতি পড়ান মকবুল স্যার-খুব ভালো জ্যামিতি জানেন তা নয় কিন্তু স্যারের উৎসাহ আছে, যেটা নিজে বুঝেছেন সেটা বোঝনোর জন্যে খুব চেষ্টা করেন। অন্যান্য দিন রূপা এই ক্লাশে মনোযোগ দেয়, আজ ঠিক মনোযোগ দিতে পারছিল না। সকালবেলা বাসা থেকে বের হবার সময় যে মেজাজটা খিচে গিয়েছিল সেটা আর কিছুতেই ঠিক করা যাচ্ছিল না।
জ্যামিতি ক্লাশের পর ইংরেজি ক্লাশ। ইংরেজি ক্লাশ নেন জিনিয়া মিস। জিনিয়া মিস স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমিসট্রেস। সবসময় কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত থাকেন তাই তার ক্লাশে আসতে দেরি হয়। আজকেও দেরি হতে থাকল আর পুরো ক্লাশের ছেলেমেয়েরা আস্তে আস্তে হইচই শুরু করে দিল। ক্লাশ ক্যাপ্টেন মাসুক ক্লাশের সামনে গিয়ে একটা খাতা খুলে চোখ পাকিয়ে বলল, “খবরদার কেউ কথা বলবি না, তা হলে কিন্তু নাম লিখে ম্যাডামকে দিয়ে দেব।”
কেউ তার কথাকে কোনো গুরুত্ব দিল না। সবাই জানে মাসুকের মনটা খুবই নরম। কোনোদিন সে কোনো ছেলে বা মেয়ের নাম লিখে স্যার কিংবা ম্যাডামকে দিতে পারবে না। মাসুককে কোনো পাত্তা না দিয়ে সবাই নিজেদের মাঝে কথা বলতে লাগল। অন্যদিন হলে রূপা নিজেও কথা বলতে শুরু করত কিন্তু আজকে তার আর ইচ্ছে করছিল না। সে ডেস্কে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে বসে ক্লাশের সবাইকে দেখতে লাগল।
“তোমার কী হয়েছে? কিছু নিয়ে মন খারাপ?” গলার স্বর শুনে রূপা ঘুরে তাকাল, রাজু একটা গল্পের বই পড়ছিল (বইয়ের নাম কবি, লেখকের নাম তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়), পড়া বন্ধ করে চশমার ফাঁক দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। .
রূপা বলল, “না। মন খারাপ কেন হবে?”
রাজু বলল, “ও আচ্ছা ঠিক আছে।” তারপর সে আবার কবি বইয়ে ডুবে গেল। রূপা কিছুক্ষণ রাজুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তোমার কেন মনে হচ্ছে আমার মন খারাপ?”
রাজু বইটা বন্ধ করে হাসি হাসি মুখ করে বলল, “ক্লাশে কোনো কথা বলছ তো তাই!”
“আমি কী ক্লাশে বেশি কথা বলি?”
রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “না। খুব বেশি না। কিন্তু স্যারেরা যখন ভুলভাল পড়ায় তখন তুমি সবসময় স্যারদের ধর। আজকে কিছু বলনি। কাউকে ধরনি।”
“মকবুল স্যার ভুলভাল পড়িয়েছেন?”
“হ্যাঁ। সিরিয়াস উল্টাপাল্টা জিনিস পড়িয়েছেন।” রাজু দাঁত বের করে হাসল। রূপা লক্ষ করল রাজুর দাঁতগুলো সুন্দর, টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনের মতো। একটা ছেলের মুখে এত সুন্দর দাঁত অপচয়ের মতো। মেয়েদের মুখে হলে অনেক মানাত।
রূপা জিজ্ঞেস করল, ”স্যার উল্টা-পাল্টা জিনিস পড়ালে তুমি ধরলে না কেন?”
রাজু খুক খুক করে হাসল যেন রূপা খুব মজার কথা বলেছে, “আমি কখনো কাউকে ধরি না!”
“আমি ধরি। আমি কাউকে ছাড়ি না।”
“জানি। সেই জন্যে জিজ্ঞেস করছিলাম তোমার মন খারাপ কি না–আজকে ছেড়ে দিলে তো।”
রূপা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “ঠিক মন খারাপ না–একটু মেজাজ খারাপ।”
রাজু বলল, “ও আচ্ছা।”
রূপা লক্ষ করল রাজু ছেলেটা জানতে চাইল না কী নিয়ে মেজাজ খারাপ! মনে হয় কখনোই সে নিজে থেকে কিছু জানতে চায় না। রূপা হঠাৎ করে নিজেই বলে ফেলল, “আজকে আমার আম্মু আমাকে খুব বকা দিয়েছে। শুধু শুধু।”
ছেলেটা হাসি হাসি মুখে বলল, “আম্মুরা সবসময় বকাবকি করে, সেগুলো এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিতে হয়।”
“যদি বের না হয়?”
“চেষ্টা করলে সব বের হয়ে যায়।”
রূপা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আজ সকালে নাস্তা পর্যন্ত করতে পারি নাই।”
“তুমি নাস্তা করনি?”
রূপা মাথা নাড়ল, বলল, “না।”
রাজু তখন তার ব্যাগের ভেতর হাত ঢুকিয়ে একটা বড় চকলেটের বার বের করে রূপার দিকে এগিয়ে দিল, বলল, “নাও এইটা খাও।”
“আমি খাব?”
“হ্যাঁ।”
রূপা একটু লজ্জা পেয়ে গেল, মাথা নেড়ে বলল, “না, না! আমি কেন খাব?”
“খেয়ে দেখ, খুব মজা। আমেরিকার চকলেট, মিস্টার গুডবার। এইটা খেয়ে একটু পানি খেয়ে নিলে তোমার পেট ভরে যাবে।”
এত বড় চকলেটের বার দেখে রূপার জিবে একেবারে পানি এসে যাচ্ছিল তারপরও সে বলল, “না, না তুমি খাও।”