মিম্মি ফিসফিস করে বলল, “বেঁচে গেছি আমরা।”
“হ্যাঁ। প্রাণে বেঁচে গেছি। পালা।” রূপা হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল।
মিম্মি জিজ্ঞেস করল, “কী হল?”
“ধোঁয়া যখন কমে যাবে তখন ঐ লোকগুলো আবার বাসাটাতে ঢুকবে। ঢুকে যখন দেখবে ভেতরে আমরা নেই তখন বের হয়ে আমাদের খুঁজবে। না হয় নিজেরাও পালাবে। তাদেরকে আর ধরা যাবে না।”
“তা হলে তুই কী করবি?”
“লোকগুলো যখন ভেতরে ঢুকবে তখন বাইরে থেকে ছিটকিনি দিয়ে লোকজনকে ডেকে আনব, পুলিশকে ফোন করব।”
“বাইরে থেকে যদি ছিটকিনি দেওয়া না যায়?”
“তা হলে অন্য ব্যবস্থা–আগে গিয়ে দেখি।”
মিম্মি মাথা নেড়ে বলল, “তোর মাথা খারাপ হয়েছে? কোনোমতে পালিয়ে এসেছি এখন ভেতরে গিয়ে আবার ধরা খাব? মরে গেলেও না।”
রূপা বলল, “ঠিক আছে, তোরা তা হলে এইখানে অপেক্ষা কর। আমি বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে আসি।”
রাজু বলল, “তুমি একা যাবে কেন? আমিও আসি।”
“যাবে আমার সাথে? ঠিক আছে আসো।”
রাজু বলল, “অন্ধকার আছে, আমাদের কেউ দেখবে না।”
মিম্মি বলল, “তোরা একা একা যাবি না। চেষ্টা কর অন্য মানুষজনকে সাথে নিয়ে যেতে।”
রূপা বলল, “দেখি।”
.
রাজু আর রূপা খুব সাবধানে বাসাটার সামনে গেল। সেখানে মানুষের ভিড়, সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। রাজু আর রূপা একটু দূর থেকে দেখল ধোয়াটা কমে যাবার পর ড্রাগ ডিলারের দলটা ভেতরে ঢুকে গেল, ওরা গুনে গুনে যখন দেখল ছয়জনই ঢুকেছে তখন তারা সাবধানে এগিয়ে গেল। তখনো বাসার সামনে মানুষের জটলা-রূপা মানুষগুলোকে বলল, “প্লীজ আপনারা চলে যাবেন না!”
বয়স্ক একজন বলল, “কেন? কী হয়েছে?”
“বলছি। একটু দাঁড়ান। আগে দরজায় ছিটকিনিটা লাগিয়ে দিয়ে আসি।”
“ভেতরে মানুষ, বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগালে মানুষগুলো বের হতে পারবে না।”
“সেই জন্যেই লাগাচ্ছি যেন মানুষগুলো বের হতে না পারে।”
“কী আশ্চর্য! কেন?”
“বলছি, একটু দাঁড়ান। বলে রূপা আর রাজু বাসাটার দিকে ছুটে গেল। কপাল ভালো সত্যি সত্যি বাইরে একটা ছিটকিনি আছে। তারা সাবধানে ছিটকিনি লাগিয়ে ফিরে এলো।
বয়স্ক মানুষটি বলল, “কিন্তু ভেতরে আগুন–”
রূপা মাথা নাড়ল, “না, আগুন না। শুধু ধোয়া।”
“তুমি কেমন করে জান?”
“কারণ আমরা পালানোর জন্যে তৈরি করেছিলাম। আমাদের কিডন্যাপ করে ভেতরে আটকে রেখেছিল।
এবারে আরো কিছু মানুষ এগিয়ে এলো, বলল, “কী বলছ?”
“সত্যি বলছি। প্লীজ আপনারা কেউ একজন পুলিশকে ফোন করে দেন। প্লীজ। তাড়াতাড়ি।”
কয়েকজন মোবাইল ফোন বের করল, কিন্তু দেখা গেল কারো কাছে পুলিশের নাম্বার নেই। রাজু তখন তাড়াতাড়ি তার পকেট থেকে সোহেলের আব্বুর নাম্বার বের করে বলল, “এখানে ফোন করে বলে দেন। তা হলেই হবে–”
একজন নাম্বার ডায়াল করে কথা বলে ফোনটা রূপার হাতে দিয়ে বলল, “নেও। তোমার সাথে কথা বলবেন।”
রূপা ফোনটা হাতে নিল ভেবেছিল অন্য পাশে সোহেলের আব্বুর গলার স্বর শুনবে কিন্তু একজন মহিলার গলার স্বর শুনল।”হ্যালো। আমি সোহেলের আম্মু-কী হয়েছে? সোহেল কোথায়?”
“চাচি, সোহেল আর আমরা পালিয়ে বের হয়ে এসেছি। কিডন্যাপারগুলো বাসার ভেতরে আছে। ওদেরকে ধরার জন্যে পুলিশকে খবর দিতে হবে। এক্ষুনি। ওরা খুব ডেঞ্জারাস মানুষ।”
“আমরা থানাতেই আছি, পুলিশকে দেই, কোথায় আসতে হবে বল।”
রূপা ঠিকানা জানে না বলে আবার ফোনের মালিককে কথা বলতে দিল। মানুষটি এলাকার ঠিকানা বলে দিল। রূপা শুনল ঠিকানা বুঝিয়ে দেবার পর মানুষটি বলছে, “আপনারা চিন্তা করবেন না। আমরা আছি। ছেলেমেয়ের গায়ে কেউ হাত দিতে পারবে না। ড্রাগ ডিলাররাও পালাতে পারবে না।”
ড্রাগ ডিলাররা কিছুক্ষণের মাঝেই দরজা ধাক্কাধাক্কি শুরু করে দিল কিন্তু ততক্ষণে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে বাসাটা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। মানুষজনের ভিড় দেখে মিম্মি আর সঞ্জয়ও ওদের কাছে চলে এলো। সোহেলকে দেখে মনে হল এখনো সে একটা ঘোরের মাঝে আছে, চারপাশে কী হচ্ছে বুঝতে পারছে না। রূপাকে দেখে ফিসফিস করে বলল, “রূপা! তুই বলেছিলি আমাকে একটা বুলবুলি দিবি। দে না! না হলে মরে যাব।”
রূপা বলল, “মরবি না। একটু অপেক্ষা কর।”
কিছুক্ষণের মাঝে পুলিশের গাড়ি চলে এলো, পুলিশেরা হাতে রাইফেল নিয়ে বাসাটার দিকে ছুটে যেতে থাকে। পুলিশ নামার পর গাড়ি থেকে সোহেলের বাবা আর তার মা নেমে এলেন। সোহেলকে দেখে সোহেলের মা ছুটে এলেন, সোহেল তখন কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। মনে হল সে বিশ্বাস করতে পারছে না, ফিসফিস করে ভাঙা গলায় বলল, “মা। তুমি?”
“হ্যাঁ বাবা। তোর এ কী অবস্থা হয়েছে?”
“মা, আমি মরে যাচ্ছি মা। আমাকে একটু ধরবে?”
সোহেলের মা ছুটে এসে সোহেলকে ধরলেন আর ঠিক তখন সোহেল এলিয়ে পড়ে গেল। সোহেলের মা চিৎকার করতে লাগলেন, “সোহেল! সোহেল বাবা–”
রূপা সোহেলের মায়ের হাত ধরে বলল, “চাচি, এক্ষুনি হাসপাতালে নেন, ওর ড্রাগ উইথড্রয়াল সিনড্রোম হচ্ছে।”
সোহেলের মা কেমন যেন বিস্ফারিত চোখে তার ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
.
১৫.
রূপা, রাজু, মিম্মি আর সঞ্জয় স্কুল মাঠের মাঝখানে বসে আছে। এখানে ওদের স্মোক বম্বটা জ্বালানোর কথা ছিল, গলগল করে নানা রঙের ধোঁয়া বের হয়ে আসত আর সেটা ঘিরে ছোট ছোট বাচ্চাদের লাফ-ঝাঁপ দেওয়ার কথা ছিল। সঞ্জয়ের ধারণা তাদের স্মোক বম্বটা নির্ঘাত ফাস্ট প্রাইজ পেয়ে যেত যদিও রূপা জানে তার সম্ভাবনা খুব বেশি ছিল না। তবে দেখানোর জন্যে সেটা চমৎকার একটা প্রজেক্ট ছিল। কিন্তু এখন তাদের দেখানোর কিছু নেই, যতগুলো স্মোক বম্ব বানিয়েছিল সবগুলো ড্রাগ ডিলারের বাসায় জ্বালিয়ে দিয়ে এসেছে। নতুন করে বানানোর সময় নেই, কেমিক্যাল কেনার টাকাও নেই! ফিল্মের কৌটায় খাবার সোডা আর ভিনেগার দিয়ে কার্বন ডাই-অক্সাইড বানানোর প্রজেক্টটাও শেষ করতে পারেনি। ড্রাগ ডিলারদের ধরার পর তাদের অনেকবার থানা-পুলিশ করতে হয়েছে। ভাগ্যিস পুলিশের বড় অফিসাররা একটু পরে পরে তাদের সাহস আর বুদ্ধির প্রশংসা করেছে, বিশাল এক ড্রাগ ডিলারদের দল ধরে ফেলে এলাকার অনেক মানুষের জীবন বাঁচিয়ে ফেলেছে বলে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে তা না হলে বাসায় বাবা-মায়েরা তাদের বারোটা বাজিয়ে ফেলতেন। ভেতরে ঠিক কী হয়েছে কেউ জানে না। সবাই ধরে নিয়েছে সোহেলকে ড্রাগ ডিলাররা ধরেছিল, সোহেলের টিম বলে তাদেরকেও ধরেছে। তারা বুদ্ধি খাঁটিয়ে পালিয়ে এসেছে আর ড্রাগ ডিলারদের ধরেও ফেলেছে। পুলিশ বলেছে এটা নিয়ে বেশি কথা না বলতে–যত কম মানুষ জানে তত ভালো, ড্রাগ ডিলাররা না কী খুব সাংঘাতিক, দল অনেক বড়। সোহেল সম্পর্কে সবাই এখন ভাসা ভাসা জানে। তার মা ঢাকায় নিয়ে কোনো একটা হাসপাতালে ভর্তি করেছেন, সেরে উঠতে সময় নেবে। এই বছর স্কুলে যেতে পারবে না। প্রাণে বেঁচে গেছে এটাই বেশি।