বসের পাশে আরো দুইজন মানুষ বসে আছে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে দুইজন-রাজু এই দুইজনকে চিনতে পারল। একজনের নাম আক্কাস অন্যজন বকর, চায়ের দোকানে রাজু তাদের দুইজনকেই দেখেছিল। চায়ের দোকানের দোকানি মেঝেতে পা ভাঁজ করে বসে আছে। ঘরের ভেতর বেশ কয়েকজন সিগারেট খাচ্ছে, তবে সিগারেটের সাথে নিশ্চয়ই কোনো নেশার জিনিস আছে কারণ ঘরের ভেতর এক ধরনের বোটকা গন্ধ।
এই ঘরের মাঝে রূপা, রাজু, মিম্মি আর সঞ্জয়কে আনা হয়েছে। তারা ঘরের একপাশে দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সাথে কেউ কোনো কথা বলছে না, মনে হচ্ছে তারা যে এখানে দাঁড়িয়ে আছে সেটা বুঝি সবাই ভুলেই গেছে।
দিনেরবেলা ঘরের মাঝে অনেক আলো তারপরও বস তার টেবিলের উপর একটা মোমবাতি জ্বালাল। তারপর টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা চামচ বের করে আনে। পকেট থেকে কয়েকটা রঙিন ট্যাবলেট বের করে চামচের উপর রাখে তারপর চামচটা মোমবাতির শিখার উপরে রেখে ট্যাবলেটগুলো গরম করতে থাকে। দেখতে দেখতে ট্যাবলেটগুলো গলে সেখান থেকে ধোঁয়া বের হতে থাকে। বস তখন চামচটার খুব কাছে নাক লাগিয়ে সেই ধোঁয়াটা নাকের মাঝে টেনে নিতে শুরু করে। সাথে সাথে তার চেহারা পরিবর্তন হতে শুরু করে, মুখটা টকটকে লাল হয়ে ওঠে, তার মুখের মাংসপেশী অনিয়ন্ত্রিতভাবে নড়তে থাকে। মুখ থেকে লালা বের হয়ে আসে, সে হাতের উল্টাপিঠ দিয়ে লালাটা মুছে নেওয়ার চেষ্টা করে। রূপা দেখল মানুষটার চোখ উল্টে যাচ্ছে, দ্রুত নিশ্বাস নিচ্ছে আর শরীরটা থরথর করে কাঁপছে।
বস নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে নিজের হাত কামড়ে ধরে গোঙানোর মতো শব্দ করে চাপা গলায় বলে, “একটা বোতল।”
কেউ একজন কালচে লাল রঙের পানীয় ভরা একটা বোতল তার হাতে ধরিয়ে দেয়। সে মুখে লাগিয়ে ঢক ঢক করে খানিকটা খেয়ে মুখ তুলে তাকাল, বিড়বিড় করে বলল, “তোদের কে পাঠিয়েছে?”
রূপা, রাজু কিংবা মিম্মি সঞ্জয়ের কেউই বুঝতে পারল না যে তাদেরকে প্রশ্নটা করা হয়েছে। তাই তারা কিছু বলল না। বস তখন হঠাৎ সোজা হয়ে বসে দুই হাতে টেবিলে জোরে থাবা দিয়ে চিৎকার করে বলল, “কে পাঠিয়েছে তোদের?”
রাজু ভয়ে ভয়ে বলল, “আ-আমাদের?”
“হ্যাঁ। কে পাঠিয়েছে?”
“আমাদেরকে কেউ পাঠায়নি।”
“তুই বলবি আর আমরা সেটা বিশ্বাস করব? গোপন পাসওয়ার্ড বলে আমাদের মাল নিয়ে গেলি আর সেইটা এমনি এমনি হয়েছে? কার জন্যে কাজ করিস তোরা?”
“আমরা কারো জন্যে কাজ করি না।”
বস ভয়ংকর খেপে গেল, হাতের বোতলটা হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে তাদের দিকে ছুঁড়ে দিল। অল্পের জন্যে সেটা মিম্মির মাথায় না লেগে পিছনের দেয়ালে লেগে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল, ভেতরের তরলটা ছিটকে সারা ঘরের মাঝে একটা ঝাঁঝালো গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। বস হিংস্র মুখে বলল, “খুন করে ফেলব আমি। এখনো বল তোরা কার জন্যে কাজ করিস? আমাদের মাল ডেলিভারি নেবার জন্যে তাদেরকে কে পাঠিয়েছে?”
মিম্মি হঠাৎ ভয়ে আতঙ্কে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে কিছু একটা বলার চেষ্টা করল কিন্তু তার কথায় কিছুই বোঝা গেল না। বস তখন প্রচণ্ড জোরে একটা ধমক দিয়ে বলল, “চোপ! চোপ ছেমড়ি। কাঁদবি না।”
মিম্মি তখন আরো জোরে কেঁদে উঠল।
বসের পাশে বসে থাকা কালো মতোন মানুষটা বলল, “বস, আমার মনে হয় ইদরিসের দল। আমি শুনছি ইদরিস স্কুলের বাচ্চাদের ব্যবহার করে। প্রথমে ফ্রি বুলবুলির ব্যবস্থা করে দেয়। যখন এডিক্ট হয়ে যায় তখন এদেরকে বন্দি গোলামের মতো ব্যবহার করে।”
বস তখন ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোরা কী ইদরিসের দলের সাথে কাজ করিস?”
সবাই মাথা নাড়ল। বলল, “না।”
কালো মতোন মানুষটা বলল, “কাজ করলেও স্বীকার করবে না বস। ইদরিস খুবই চালু, তার দলে কে কোন দায়িত্বে থাকে কেউ জানে না।”
আক্কাস বলল, “মাইর দিলে সবকিছু বলে দেবে। আমার হাতে দেন আমি ঠিকমতো বানাই। দেখবেন সবকিছু বলে দেবে।”
বকর মাথা নাড়ল, “এইটা সত্যি কথা। মাইরের ওপরে ওষুধ নাই।”
বস বলল, “কেমন করে কথা বের করতে হয় সেইটা তোমাদের আমারে শিখাতে হবে না। আমার নাক টিপলে দুধ বের হয় না। দল কেমন করে চালাতে হয় আমি জানি।”
আক্কাস শুকনা মুখে বলল, “জে বস। অবশ্যি জানেন।”
“তোমরা জান না কেমন করে কাজ করতে হয়। গোপন পাসওয়ার্ড বলে আণ্ডা-বাচ্চারা মাল ডেলিভারি নেয়। তার অর্থ কী?”
আক্কাস ও বকর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর সাহস করে চায়ের দোকানের দোকানিকে দেখিয়ে বলে, “বস, আমাদের দোষ নাই। এই মদন-”
বস ধমক দিয়ে বলল, “গোপন পাসওয়ার্ড অন্যেরা কেমন করে জানল। তোমরা মানুষরে বলছ?”
দোকানি দাঁড়িয়ে কাচুমাচু করে বলল, “আল্লাহর কসম বস। কাউরে বলিনি। কেউ ছিল না আশেপাশে—”
“খবরদার আমার সামনে কিরা-কসম কাটবি না।” আমি কিরা-কসম শুনতে চাই না, আমি কোনো ওজুহাত শুনতে চাই না। আমি কাজ চাই।”
কালো মতোন মানুষটা বলল, “বস। এই চাইরটা পোলা-মাইয়া তো ভদ্রলোকের ঘর থেকে আসছে। এদের ফ্যামিলিরে চাপ দিলেও তো পাঁচ-দশ লাখ টাকা আসবে। আসবে না?”
“আসবে। কিন্তু আমাদের ব্যবসা কি কিডন্যাপিং? এই রকম উল্টা-পাল্টা ঝামেলা হাতে নিলে পরে সামলাবে কে? আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের ড্রাগ খাওয়া শিখানো। যত ছোটদের শিখাতে পার তত ভালো। একবার এডিক্ট হয়ে গেলে পারমানেন্ট কাস্টমার। সারাজীবনের জন্যে নিশ্চিন্ত। আর আমাদের ব্যবসাও নিশ্চিন্ত।”