আম্মু চিৎকার করে বললেন, “সাহায্য করবি? আয়। বটি দিয়ে কোপ মেরে আমার মাথাটা আলাদা করে দে।”
রূপা উত্তরে কী বলবে বুঝতে পারল না।
খাবার টেবিলে সবাই নিঃশব্দে নাস্তা খাওয়ার চেষ্টা করল। কয়েকটা পোড়া টোস্ট এবং কয়েকটা পরোটা। পরোটাগুলো আসলেই পরোটা না কী তেলে ভেজা রুটি বোঝা যাচ্ছে না। সেগুলো গোল নয়, দেখে মনে হয় কোনোটা অস্ট্রেলিয়ার ম্যাপ, কোনোটা আফগানিস্তানের ম্যাপ! কয়েকটা ডিম ভাজা হয়েছে, তার মাঝে ডিমের খোসা রয়ে গেছে। ডিমের এক অংশে লবণের তেতো অন্য অংশে লবণের চিহ্ন নেই। মুখে দিলে উগলে দিতে ইচ্ছে করে। আব্বু গম্ভীর মুখে পরোটাটা টেনে ছেঁড়ার চেষ্টা করতে করতে হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, “বাসার কাজের জন্যে একজন বুয়া না পেলে মুশকিল।”
আম্মু দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন, “কেন? আমাকে বুয়া হিসেবে পেয়ে তোমাদের মন ভরছে না?”
আল্লু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “না আমি সেটা বলিনি। তুমি কেন বুয়া হতে যাবে?”
“বুয়া তো হয়েই গেছি। বুয়া হইনি? এই বাসায় চব্বিশ ঘণ্টা কে বুয়ার কাজ করে? কে? আর তোমরা লাটসাহেবরা কী করো? নবাবের বাচ্চার মতো কে বসে থাকে?”
আম্মু কিছুক্ষণ চিৎকার করলেন, তারপর আব্বুও চিৎকার শুরু করলেন। তারপর আবার দুইজন ঝগড়া শুরু করে দিলেন।
১৩-১৬. জ্যামিতি ক্লাশ শেষ হয়েছে
জ্যামিতি ক্লাশ শেষ হয়েছে সমাজপাঠ এখনো শুরু হয়নি ঠিক এরকম সময় একজন দপ্তরি একটা নোটিশ নিয়ে এলো। দপ্তরিরা সাধারণত স্যার-ম্যাডাম না আসা পর্যন্ত নোটিশ পান না। কিন্তু আজকে মনে হয়ে জরুরি কিছু ঘটেছে। ক্লাশরুমে ঢুকে বলল, “তোমাদের চাইরজনকে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বোলায়।”
মাসুক জিজ্ঞেস করল, “কোন চারজন?”
দপ্তরি তখন হাতের চিরকুটটা দেখে পড়ল, “রাজু, সঞ্জয়, রূপা আর মিম্মি।”
চারজনেরই বুকটা ধড়াস করে উঠল, একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল। মিম্মি ফিসফিস করে বলল, “স্মোক বম্ব।”
রূপা জিজ্ঞেস করল, “স্মোক বম্ব কী?”
“মনে নাই আমরা জ্বালালাম আর প্রিন্সিপাল ম্যাডামের ঘরে ধোয়া গেল? আমাদের টিসি দিয়ে বিদায় করে দেবে!”
“কেন টিসি দেবে? আমরা কী করেছি?”
“সারা স্কুল ধোয়া দিয়ে অন্ধকার করে দিসনি?”
“কিন্তু সেটা তো মিটে গেল। মিটে যায়নি?”
“মিম্মি মুখ শক্ত করে বলল, “নিশ্চয়ই মিটে যায়নি। দেখছিস না?”
দপ্তরি তখন তাগাদা দিল, “তাড়াতাড়ি চলো। তাড়াতাড়ি।”
চারজন তখন শুকনো মুখে রওনা দিল। সঞ্জয় দপ্তরিকে জিজ্ঞেস করল, “প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কেন ডাকছেন আমাদের? আপনি জানেন?”
দপ্তরি মাথা নাড়ল, বলল, “না জানি না। তবে—”
”তবে কী?”
“এই চৌদ্দ বছরে কখনো দেখি নাই কোনো ভালো কিছুর জন্যে ম্যাডাম কাউকে ডেকে এনেছে। তোমাদের কপালে মনে হয় দুঃখ আছে।”
প্রিন্সিপাল ম্যাডামের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রাজু শুকনো মুখে বলল, “আসতে পারি ম্যাডাম?”
“আসো।”
চারজন ভেতরে ঢুকল। ম্যাডামের অফিসঘরটা অনেক বড়। চারদিকে বড় বড় আলমারি। কিছু আলমারিতে বই, কিছু আলমারিতে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় এই স্কুলের ছেলেমেয়েদের পাওয়া মেডেল, কাপ, শিল্ড আর ক্রেস্ট। দেয়ালে স্কুলের নানা অনুষ্ঠানের বড় বড় ছবি। ঘরটা সাজানো-গোছানো এবং কেমন যেন ছমছমে ভাব।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম হাতের একটা কাগজ দেখে বললেন, “তোমরা ক্লাশ এইট বি?”
সবাই একসাথে মাথা নাড়ল, “জি ম্যাডাম।”
“রাজু, সঞ্জয়, রূপা আর মিম্মি?”
আবার মাথা নাড়ল, “জি ম্যাডাম।”
“তোমরা সবাই সোহেলের বন্ধু?”
এবার তারা লক্ষ করল ম্যাডামের অফিসে এক পাশের চেয়ারে একজন মাঝবয়সী মানুষ বসে আছে। মানুষটির পোশাক আধুনিক, গলায় টাই এবং চোখে চশমা। মিম্মি ফিসফিস করে রূপাকে বলল, “সোহেলের আব্বু।”
রূপা মাথা নাড়ল, মানুষটি নিশ্চয়ই সোহেলের আব্বু, চেহারায় হুবহু মিল।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আবার জিজ্ঞেস করলেন, “সায়েন্স ফেয়ারের জন্যে তোমরা যে টিম করেছ সেখানে সোহেল একজন মেম্বার?”
রূপা বলল, “জি ম্যাডাম।”
“তোমরা মাঝে মাঝে সোহেলের বাসায় গিয়েছ?”
“জি ম্যাডাম।”
“তার সাথে তোমাদের কথা হয়েছে? কথা হয়?”
“জি ম্যাডাম।”
“শেষবার কবে কথা হয়েছে?”
সঞ্জয় বলল, “এই তো–পাঁচ-ছয়দিন আগে।”
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম তখন চেয়ারে বসে থাকা মধ্যবয়স্ক মানুষটির দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই যে–এরাই আপনার বাসায় গিয়েছে। এদের সাথেই যোগাযোগ আছে–কথা বলেন।”
সোহেলের আব্বু বিড়বিড় করে কিছু একটা বললেন, কাকে বললেন পরিষ্কার বোঝা গেল না। ম্যাডামকেও হতে পারে, এই চারজনকেও হতে পারে। রাজু বলল, “জি চাচা-”
“সোহেল-মানে সোহেল। ইয়ে সোহেল হয়েছে কী-” সোহেলের আব্বু কথা শেষ করলেন না।
রূপা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে সোহেলের?”
“না মানে–ইয়ে নিশ্চয়ই তার আম্মুর কাছেই গিয়েছে কিন্তু মানে আমাকে বলে যায়নি।” কথাটা নিজেকে বললেন না তাদেরকে বললেন, বোঝা গেল না।
রূপা জিজ্ঞেস করল, “সোহেল তার আম্মুর কাছে চলে গেছে?”
“নিশ্চয়ই গেছে। কিন্তু মানে-” সোহেলের আব্বু তার টাইটা ঠিক করলেন, “তার আম্মু বলছে যায়নি।”
রাজু জিজ্ঞেস করল, “তা হলে কোথায় গেছে?”
“সেটাই জানতে তোমাদের কাছে এসেছিলাম। তোমরা না কী একটা টিম তৈরি করেছ। সায়েন্স ফেয়ারের টিম, সোহেলকে নিয়ে।”