রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। শুধু আরো কিছু কেমিক্যাল দরকার। জোগাড় করতে পারলে হয়।”
সবাই মাথা নাড়ল। কেমিক্যালস বেশ দামি। সব পাওয়াও যায় না। রূপা বলল, “আরেকটা কাজ করলে কেমন হয়?”
“কী কাজ?”
“আমরা যদি আরো একটা এক্সপেরিমেন্ট দাঁড়া করি!”
“কী এক্সপেরিমেন্ট?”
“ফিল্মের খালি কৌটার ভেতর একটুখানি খাবার সোডার মাঝে ভিনেগার ঢেলে কৌটাটা বন্ধ করে দেব, ভেতরে কার্বন ডাই-অক্সাইড জমা হয়ে একটু পরে ফটাশ করে ফেটে যাবে!”
মিম্মি চোখ বড় বড় করে বলল, “সত্যি?”
রূপা মাথা নাড়ল, বলল, “সত্যি। বানানো খুব সোজা-খাবার সোডা আর ভিনেগার, বাসাতেই আছে। শুধু ফিল্মের প্লাস্টিকের কৌটা লাগবে।”
রাজু বলল, “আমাদের বাসার কাছে একটা ফটো স্টুডিও আছে, আমি সেখান থেকে কাল ফিল্মের কৌটা নিয়ে আসব।”
সঞ্জয় হাতে কিল দিয়ে বলল, “ফাটাফাটি সায়েন্স ফেয়ার হবে তাই না? আমরা মনে হয় ফার্স্ট প্রাইজ পেয়ে যাব, তাই না?”
রূপা বলল, “ধুর গাধা। শুধু ধুমধাম শব্দ করলে কেউ ফার্স্ট প্রাইজ পায় না, ফার্স্ট প্রাইজ পেতে হলে সায়েন্সটা বুঝতে হয়। তুই কিছু বুঝিস? আরেকজনকে বোঝাতে পারবি?”
সঞ্জয় চিন্তিত মুখে বলল, “বোঝাতে হবে?”
“হ্যাঁ বোঝাতে হবে।” বোঝাতে না পারলে আবার সায়েন্স ফেয়ার কীসের?”
.
বিকেলবেলা বাসায় এসে রূপা খবর পেল সুলতানা চলে গেছে। তার একই সাথে খুবই মন খারাপ আর অনেক আনন্দ হল। খুবই মন খারাপ হল কারণ বাসায় সুলতানা ছিল তার এক নম্বর বন্ধু, এখন থেকে তার কোনো বন্ধু থাকল না। আনন্দ হল যে সুলতানা এই দোজখ থেকে মুক্তি পেয়েছে–যেখানেই থাকুক যত কষ্টে থাকুক তাকে আর এই দোজখে থাকতে হবে না।
বাসার অন্য সবাইকে দেখে অবশ্যি মনে হল সুলতানা চলে গিয়ে খুব বড় একটা অপরাধ করেছে। এই অপরাধের জন্যে থানায় পুলিশের কাছে জিডি করে রাখা দরকার। আম্মুর মুখ থমথম করছে। সুলতানা চলে যাবার কারণে বাসাটা যে অচল হয়ে গেছে সেটা তিনি টের পেলেন খাবার টেবিলে। সুলতানা আগামী কয়েকদিনের জন্যে রান্না করে গিয়েছে। শুধু ভাতটা রান্না করে নিতে হবে। দেখা গেল আম্মু সেই ভাতটাও ঠিক করে রান্না করতে পারলেন না।
ডিসে করে যে ভাত দেওয়া হল তার মাঝে একই সাথে গলে যাওয়া ভাত এবং অসিদ্ধ কটকটে চাউল পাওয়া গেল। আব্বুর মতো মানুষ যে আম্মুকে রীতিমতো ভয় পান, তিনি পর্যন্ত মুখে ভাত দিয়ে বিরক্ত হয়ে বলে ফেললেন, “এইটা কী বেঁধেছ? ভাত না চাউল ভাজা?”
আম্মু হিংস্র মুখে বললেন, “পছন্দ না হলে তুমি নিজে বেঁধে নাও।”
আব্বু বললেন, “দরকার হলে রাঁধব। কিন্তু একবেলা সিম্পল ভাত পর্যন্ত রাঁধতে পার না–এটা কী রকম কথা?”
তারপর আম্মু আর আব্বু খুব খারাপভাবে ঝগড়া করলেন। খাওয়া শেষ হবার পর এতদিন সবাই উঠে যেত, সুলতানা টেবিল পরিষ্কার করত, থালা-বাসন ধুত, খাবার তুলে রাখত। আজকে সেগুলো করার কেউ নেই–আম্মু করার চেষ্টা করলেন, রূপা আর তিয়াশা সাহায্য করার চেষ্টা করল, দেখা গেল সবকিছু শেষ করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে। সুলতানা একা একা এত কাজ কেমন করে করত কে জানে?
খাবার পরে আব্বু-আম্মু টেলিভিশন দেখতে দেখতে চা খেতেন–আজ আর খাওয়া হল না। চায়ের কৌটাই কেউ খুঁজে পেল না। রাতে ঘুমানোর সময় হঠাৎ করে সবাই আবিষ্কার করল মশারিগুলো কেমন করে লাগানো হয় সেটা কেউ জানে না। রূপা অনেক কষ্ট করে মশারিটা টানানোর পর আবিষ্কার করল সেটা প্রায় তার নাকের উপর ঝুলে আছে।
ঘুমানোর আগে আম্মু ব্লাড প্রেসারের ওষুধ খান, তার গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা তাই ওষুধ খাবার আগে আধা গ্লাস দুধ খান। প্রতিরাতে সুলতানা গাসে করে আধা গ্লাস দুধ টেবিলের উপর পিরিচ দিয়ে ঢেকে রাখত-আজকে আম্মুর নিজের দুধ গরম করে আনতে হল। একটুখানি অসতর্ক হয়েছিলেন বলে দুধ উপচে পড়ে রান্নাঘর মাখামাখি হয়ে গেল, সারা বাসায় একটা পোড়া পোড়া গন্ধ। দুধের ডেকচি নামাতে গিয়ে আম্মুর হাতে ছ্যাকা লেগে গেল এবং আম্মু সেটা নিয়ে সারাক্ষণ আহা-উঁহু করতে লাগলেন।
ঘুমাতে গিয়ে কেউ তাদের ঘুমানোর কাপড় খুঁজে পেল না। সুলতানা প্রতিদিন সেগুলো ভাঁজ করে বিছানার উপর রাখত আজকে কিছু নেই। অনেক খুঁজে পেতে কিছু একটা বের করে সেটা পরে তাদের ঘুমাতে যেতে হল। আম্মু প্রতি নিশ্বাসে সুলতানাকে গালি দিতে লাগলেন-ব্যাপারটা এমন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেল যে শেষ পর্যন্ত আব্বু বিরক্ত হয়ে বলে ফেললেন, “অনেক হয়েছে। এখন থামো।”
তখন আবার আল্লু আর আম্মুর মাঝে তুমুল ঝগড়া লেগে গেল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে রূপা ভেবে পেল না আগামীকাল দিনটা কেমন করে শুরু হবে। সুলতানা একা এই বাসার সবকিছু করেছে এখন কে করবে? কীভাবে করবে? আম্মু যদি কোনোভাবে জানতে পারেন যে রূপাই সুলতানাকে চলে যাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছে তা হলে মনে হয় তাকে খুনই করে ফেলবেন। শুয়ে শুয়ে রূপা মুখ টিপে হাসল, মনে মনে বলল, সুলতানা! তুমি যেখানে থাকো ভালো থাকো।
.
সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠার পর রূপা শুনতে পেল আম্মু রান্নাঘরে খুটখাট শব্দ করছেন। রূপা রান্নাঘরে গিয়ে দেখল আম্মু নাস্তা বানানোর চেষ্টা করছেন, তার চেহারা কেমন যেন উদ্ভ্রান্তের মতো। মনে হয় একদিনে বয়স দশ বছর বেড়ে গেছে, চোখের নিচে কালি, চুলগুলো উষ্কখুষ্ক। রান্নাঘর লণ্ডভণ্ড। এদিক-সেদিক থালা-বাসন পড়ে আছে। রূপা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “আম্মু তোমার কোনো সাহায্য লাগবে। আমি কিছু করব?”