“তোর জন্যে দোয়া করব? হারামজাদি।” আম্মু হিসহিস করে বললেন, “তোর গলা দিয়ে যেন রক্ত বের হয়। কুষ্ঠ রোগে তোর যেন নাক খসে পড়ে। তোর চৌদ্দ গুষ্টি যেন রাস্তায় ভিক্ষা করে। বের হয়ে যা বাসা থেকে বের হয়ে যা–”
“আমার জিনিসপত্র। গত তিন মাসের বেতন?”
“কী! গত তিন মাসের বেতন?” আম্মু এবারে ভয়ংকর আক্রোশে সুলতানার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এর আগে আম্মু যতবার সুলতানার গায়ে হাত তুলেছেন সুলতানা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে মার খেয়েছে, আজ প্রথমবার ঝাঁকুনি দিয়ে নিজেকে মুক্ত করে নিল। বলল, “অনেক মাইর খাইছি খালাম্মা। আর খামু না।”
আম্মু চিৎকার করে বললেন, “বের হয়ে যা হারামজাদি। বের হয়ে যা এক্ষুনি।”
রূপা দরজা খুলে বের হতে হতে বলল, “কয়েকদিনের জন্যে রান্না করে গেছি খালাম্মা। ফ্রিজে আছে। খালি ভাতটা বেঁধে নিবেন।”
“চুপ কর হারামজাদি”
“কাপড়গুলো ধুয়ে নেড়ে দিছি, বিকালে তুলে নিতে হবে–”
“বের হয়ে যা তুই-দূর হয়ে যা।”
সুলতানা বের হলে গেল।
.
১২.
এলুমিনিয়াম ফয়েল দিয়ে মোড়ানো কালচে জিনিসটা উপরে তুলে রূপা বলল, “এই হচ্ছে আমাদের তৈরি প্রথম স্মোক বম্ব।”
মিম্মি সন্দেহের চোখে স্মোক বম্বটার দিকে তাকিয়ে বলল, “এইটাকে মোটেও বোমার মতো মনে হচ্ছে না, দেখে মনে হচ্ছে খাবার জিনিস। পিৎজার সুইস।”
রাজু বলল, “উঁহু, এইটা খাবার জিনিস না। এইটা স্মোক বম্ব।”
সঞ্জয় উত্তেজিত গলায় বলল, “আয় টেস্ট করি। আগুন ধরিয়ে দেই।”
রূপা জিজ্ঞেস করল, “কোথায় টেস্ট করব?”
“কেন? এই বারান্দায়।”
তারা টিফিন ছুটিতে তাদের প্রথম স্মোক বম্ব তৈরি করেছে। সায়েন্স ফেয়ার নিয়ে সবার ভেতরে উত্তেজনা, অনেক ছেলেমেয়েই অনেক কিছু তৈরি করেছে, সেগুলো নানাভাবে পরীক্ষা করা হচ্ছে। কাজেই এর মাঝে টিম মিরূসোরাস যদি তাদের স্মোক বম্বটা পরীক্ষা করে দেখে তা হলে কেউ কিছু বলবে বলে মনে হয় না। তারপরও রূপা সবাইকে সাবধান করে দিয়ে বলল, “আমরা আমাদের স্মোক বম্ব টেস্ট করছি। কেউ কাছে আসবে না।”
আশেপাশে যারা ছিল তারা দূর থেকে এবারে কাছে চলে এলো ভালো করে দেখার জন্যে। রূপা তাদের ঠেলে সরানোর একটু চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে সঞ্জয়কে বলল, “সঞ্জয় আগুন দে।”
সঞ্জয় পকেট থেকে ম্যাচ বের করে তাদের স্মোক বম্বে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করল, আগুনটা জ্বলে উঠেই নিভে গেল। রাজু চিন্তিত মুখে বলল, কী হল? আগুন ধরছে না?”
সঞ্জয় বলল, “জানি না। আবার দেখি।” সে আবার ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে স্মোক বম্বের এক কোনায় ধরে রাখে এবারে হঠাৎ করে আগুন ধরে যায় তারপর চিড়চিড় শব্দ করে সেটা পুড়তে থাকে আর স্মোক বম্ব থেকে গলগল করে ধোয়া বের হয়ে চারদিক ঢেকে ফেলে। যারা স্মোক বম্ব ঘিরে দাঁড়িয়েছিল তারা আনন্দে চিৎকার করে আরো কাছে এগিয়ে আসে।
স্মোক বম্বের ধোয়া একতলার বারান্দা থেকে দোতলায় উঠে যায়, দোতলা থেকে তিনতলায়, সেখান থেকে পাশের বিল্ডিংয়ে। শুধু ধোঁয়া নয় ধোয়ার সাথে এক ধরনের ঝাঁঝালো গন্ধে চারদিক ভরে গেল।
“আগুন আগুন” বলে চিৎকার করতে করতে দোতলা থেকে কয়েকজন মেয়ে চিৎকার করে ছুটে আসতে থাকে। অফিস ঘর থেকে স্যার-ম্যাডামরা উদ্বিগ্ন মুখে বের হয়ে আসেন। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে”ফায়ার ব্রিগেড ফায়ার ব্রিগেড” বলে চিৎকার করতে থাকেন।
স্কুলের দপ্তরি এক বালতি পানি নিয়ে ছুটে আসতে থাকে। সে আসতে আসতে স্মোক বম্ব পুড়ে শেষ হয়ে গেছে, মেঝের মাঝে কালচে একটু অঙ্গার ছাড়া আর কিছুই নেই। বালতি হাতে সে অবাক হয়ে এদিক-সেদিক তাকায়, “কোথায় আগুন? কোথায়?”
রূপা বুঝতে পারল তারা অত্যন্ত সফল একটা স্মোক বম্ব তৈরি করেছে কিন্তু সেই জন্যে একটা মহা গাড্ডার মাঝে পড়েছে। স্যার-ম্যাডামের বকাবকি কিংবা প্রিন্সিপাল ম্যাডামের শাস্তি থেকে উদ্ধার পাবার কোনো উপায় ছিল না কিন্তু বিজ্ঞান ম্যাডাম তাদের রক্ষা করলেন। সবাইকে বোঝালেন এটি কোনো সত্যিকারের আগুন নয়, অত্যন্ত নিরীহ একটা স্মোক বম্ব। কিছু ধোঁয়া তৈরি করা ছাড়া আর কিছুই করে না। নিচে জড়ো হওয়া স্যার, ম্যাডাম আর প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে বললেন, “এদের কোনো দোষ নেই। দোষটা আমার, ওদের বলতে ভুলে গেছি বারান্দায় টেস্ট না করে মাঠের মাঝখানে বা ভোলা জায়গায় টেস্ট করতে হবে।”
সত্যিকারের কোনো আগুন নয় একটা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা শুনে স্যার ম্যাডামরা তাদের অফিসে ঢুকে গেলেন। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম গজগজ করে বললেন, “কী করছ না করছ সেটা একটু ভেবে দেখবে না?”
রূপা মাথা চুলকে বলল, “আমরা বুঝতে পারিনি। আর হবে না ম্যাডাম।”
“হ্যাঁ। আর যেন ভুল না হয়।”
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম চলে যাবার পর সঞ্জয় খুশিতে হাতে কিল দিয়ে বলল, “একেবারে, ফাটাফাটি আবিষ্কার! সায়েন্স ফেয়ারের সময় একসাথে দশটা জ্বালিয়ে দিয়ে সারা স্কুল ধোয়া দিয়ে অন্ধকার করে দেব।”
মিম্মি বলল, “আমরা ফার্স্ট প্রাইজ পেয়ে যাব। তাই না?”
রূপা বলল, “শুধু ধোয়া হলে সেটা তো এমন কিছু না। সিগারেট ধরালেও তো ধোঁয়া বের হয়। আমাদের এখন এই ধোঁয়াকে রং করতে হবে। লাল, নীল, বেগুনি ধোয়া যদি বানানো যায় তা হলে মজা হবে।”