মিম্মি কাছে এসে গলা নামিয়ে বলল, “জানিস কী হয়েছে?”
“কী হয়েছে?”
মিম্মি চোখ বড় বড় করে বলল, “সোহেল।”
সোহেল তাদের ক্লাশের শান্তশিষ্ট দ্র একজন ছেলে। কারো সাতে-পাঁচে নেই, লেখাপড়াতেও ভালো সে কীভাবে মিম্মির বিষ নজরে পড়ে গেল কে জানে? রূপা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে সোহেলের?”
“তুই জানিস না কিছু?”
রূপা মাথা নাড়ল, “না।”
“কী সর্বনাশ! সোহেলের বাবা-মা-” মিম্মি ইচ্ছে করে বাক্যটা শেষ না করে মাঝখানে থেমে গেল।
“কী হয়েছে সোহেলের বাবা-মায়ের?”
“হেভি ফাইটিং। এখন ডিভোর্স।”
রূপা চোখ কপালে তুলে বলল, “ডিভোর্স হয়ে গেছে?”
“না। এখনো হয়নি। কিন্তু হবে। যেরকম ডেঞ্জারাস অবস্থা ডিভোর্স যদি না হয় তা হলে মার্ডার।”
“মার্ডার?”
“হ্যাঁ। একটা না, ডাবল মার্ডার।”
ঠিক এরকম সময় সোহেলকে দেখা গেল, সে স্কুল ব্যাগ নিয়ে ক্লাশে ঢুকে একটা বেঞ্চে তার ব্যাগ রেখে দাঁত দিয়ে নখ খুঁটতে খুঁটতে ক্লাশের অন্য বন্ধুদের দিকে এগিয়ে গেল। তার চেহারা বা ভাবভঙ্গিতে কোথাও বাবা-মায়ের ডিভোর্স কিংবা ডাবল মার্ডারের চিহ্ন দেখা গেল না।
মিম্মি তাতেও খুব নিরুৎসাহিত হল বলে মনে হল না, জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে বলল, “দেখলি? দেখলি?”
“কী দেখব?”
“এরকম একটা ব্যাপার ফ্যামিলিতে কিন্তু কাউকে একটুও বুঝতে দিচ্ছে না! কী কঠিন অভিনয়!”
“তুই কেমন করে জানিস? আসলে হয়তো ওগুলো কিছুই হয়নি—”
“হয়েছে।”
“ঠিক আছে, জিজ্ঞেস করে দেখি।” রূপা গলা উঁচিয়ে সোহেলকে ডাকার চেষ্টা করল, “এই সোহেল শুন তো একটু।”
মিম্মি লাফিয়ে রূপার মুখ চেপে ধরল। তাই শব্দটা বের হতে পারল না। মিম্মি বলল, “সর্বনাশ! তুই কী করছিস? জানাজানি হলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।”
“তুই সবাইকে বলে বেড়াচ্ছিস-জানাজানির বাকি থাকল কী?”
“আমি সবাইকে মোটেও বলে বেড়াচ্ছি না।”
“এই যে আমাকে বললি।”
“তোকে বলা আর সবাইকে বলা এক কথা হল?”
“তুই আর কাউকে বলিসনি?”
“না।” মিম্মি মুখ শক্ত করে বলল, “আর কাউকে বলিনি। শুধু তানিয়া আর টুশি আর–”
রূপা মাথা নেড়ে বলল, “আর মৌমিতা আর সাবা আর বৃষ্টি আর মিলি আর সামিয়া আর লিজা-”
“বলিনি।” মিম্মি গলা উঁচিয়ে বলল, “মোটেও আমি লিজাকে বলিনি। আমি লিজার সাথে কথা পর্যন্ত বলি না। তুই এত বড় মিথ্যুক।”
রূপা প্রায় হাল ছেড়ে দিল। দিনটা এখনো শুরু হয়নি, এখনই পেটে খিদে লেগে গেছে, সারাটা দিন কেমন করে যাবে? খিদে পেটে তার আর মিম্মির সাথে ঝগড়া করার ইচ্ছা করল না। সে চুপ করে গেল। এমনিতেই চুপ করে যেত তার কারণ ঠিক তখন সঞ্জয় হেলতে-দুলতে এগিয়ে আসছিল। সঞ্জয় হচ্ছে তাদের ক্লাশ জোকার, সে সবসময় কিছু না কিছু নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করছে, সেই ঠাট্টা তামাশা নিয়ে অন্য কেউ হাসুক আর নাই হাসুক সে নিজে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে থাকে।
সঞ্জয় এসে ডেস্কে তার ব্যাগটা রেখে একবার রূপার দিকে তাকাল তারপর মিম্মির দিকে তাকাল, তারপর কথা নেই, বার্তা নেই, হি হি করে হাসতে শুরু করল। রূপা চোখ পাকিয়ে বলল, “তুই এভাবে হাসছিস কেন ছাগলের মতো?”
রূপার কথা শুনে সঞ্জয়ের হাসি মনে হয় আরো বেড়ে গেল–সে তখন একটু বাঁকা হয়ে পেটে হাত দিয়ে হাসতে শুরু করে। মিম্মি এবারে একটু রেগে গেল, ধমক দিয়ে বলল, “কী হল তোর? বলবি এখানে হাসির কী আছে?”
সঞ্জয় অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল, “তো-তোরা দুজন–” সে কথা শেষ করতে পারল না আবার হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল।
“আমরা দুজন কী?”
“তোদের দুজনকে দেখে মনে হচ্ছে—” আবার হাসি।
”আমরা দুজন কী?”
“মনে হচ্ছে তোদের দুজনকে কেউ আধ-চামচ করে ইয়ে খাইয়ে দিয়েছে।” বলে সঞ্জয় আবার হাসিতে গড়াগড়ি খেতে থাকে। মিম্মি বোকার মতো জানতে চাইল, “কীয়ে খাইয়ে দিয়েছে?”
সঞ্জয় হাসতে হাসতে লাফাতে থাকল, মিম্মির কথার উত্তর দিল না। কোনো জিনিস খাইয়ে দেওয়াটা এরকম হাসির ব্যাপার হতে পারে সেটা অনুমান করতে অবশ্যি মিম্মি বা রূপা কারোই অসুবিধে হল না। রূপা হাত পাকিয়ে ঘুষির ভঙ্গি করে বলল, “দেখ সঞ্জয় নোংরা কথা বলবি না।”
রূপার কথা শুনে সঞ্জয়ের মনে হল আরো হাসি পেয়ে গেল, এবারে হাসির দমকে তার শরীর কাঁপতে থাকে, মুখ দিয়ে আর কোনো শব্দ বের হয় না। হাসি মনে হয় এক ধরনের সংক্রামক ব্যাপার, সঞ্জয়ের একেবারে পুরোপুরি অর্থহীন বোকার মতো হাসি দেখে রূপা আর মিম্মিরও হাসি পেয়ে যায়, তারাও একসময় হাসতে শুরু করে। রূপা হাসতে হাসতে বলল, “ঠিক আছে সঞ্জয়, অনেক হয়েছে। এখন থাম।”
সঞ্জয় হাসতে হাসতে বলল, “থামতে পারছি না! কিছুতেই থামতে পারছি না।”
এটা সঞ্জয়ের সমস্যা-সে যখন একবার হাসতে শুরু করে তখন সে আর থামতে পারে না। একেবারে বিনা কারণে হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেতে থাকে। রূপা বলল, “যদি থামতে না পারিস তা হলে বাইরে চলে যা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসতে থাক।”
সঞ্জয় মাথা নেড়ে একটু কাছে এসে কোনোমতে একটু হাসি থামিয়ে বলল, “আমাকে শক্ত করে একটা কিল দে দেখি।”
“কিল?”
“হ্যাঁ।” আবার হাসি।
”কেন?”
“জোরে কিল দিলে মনে হয় হাসিটা থামাতে পারব।” কথা শেষ করে আবার হাসি।
রূপা কিল নয় একটা ফুলসাইজ ঘুষি দেওয়ার জন্যেই হাত পাকিয়ে এগিয়ে গেল কিন্তু ঠিক তখন অ্যাসেম্বলির ঘণ্টা পড়ে গেল। ঘণ্টার শব্দের কারণেই হোক বা অন্য কারণেই হোক সঞ্জয়ের হাসি থেমে আসে। সে তখন তার শার্টের হাতায় নিজের নাকটা মুছে নিল, হাসি তখনো দমকে দমকে আসছে। সেটা সামলে নিয়ে