সুলতানা তখন সুরুত করে লাইনে ঢুকে গেল। পিছন থেকে একটা শশারগোল হল কিন্তু মহিলাটি কোমরে হাত দিয়ে পিছনে তাকিয়ে হুংকার দিয়ে বলল, “কে আওয়াজ দেয়?”
পিছনের শোরগোলটা হঠাৎ করে থেমে গেল।
আধঘণ্টা পর সুলতানা একটা খোলা গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল তারপর কয়েক মিনিটের ভেতরেই বের হয়ে এলো, হাতে একটা কাগজ আর মুখে হাসি।
রূপা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হল সুলতানা? কী হল?”
সুলতানা কাগজটা রূপার দিকে এগিয়ে দেয়, “এই যে! চাকরি হয়ে গেছে। আমি এখন জজ-ব্যারিস্টার অফিসার। আট ঘণ্টার শিফট, দুই হাজার টাকা বেতন।”
রূপা নিশ্বাস ছেড়ে বলল, “সত্যি?”
“সত্যি।”
রূপার তখনো বিশ্বাস হয় না, “খোদার কসম?”
“খোদার কসম।”
রূপা তখন সুলতানাকে জড়িয়ে ধরল। সুলতানার হি হি করে হাসার কথা কিন্তু সে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল।
.
আম্মু ঢোক গিলে বললেন, “কী বললি?”
সুলতানা মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি আর কাজ করমু না।”
আম্মু কঠিন গলায় বললেন, “কাজ করবি না? তা হলে খাবি কী? থাকবি কোথায়?”
“আমি গার্মেন্টসে কাজ করমু।”
মনে হল আম্মু কথাটা বুঝতে পারলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, “কীসে কাজ করবি? গার্মেন্টসে?”
“জে?”
আম্মু খলখল করে হাসলেন, বললেন, “তোর ধারণা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিকেরা তোরে চাকরি দেওয়ার জন্যে বসে আছে? চাকরি করা এত সোজা? তুই যাবি আর তোরে হাজার টাকা বেতনে চাকরি দিয়ে দেবে?”
সুলতানা বলল, “আমি চাকরি পেয়ে গেছি।”
মনে হল আম্মু একটা ইলেকট্রিক শক খেলেন।
কয়েকবার চেষ্টা করে বললেন, “চাকরি পেয়ে গেছিস?”
“জে।”
“কো-কোথায়?”
“জানে আলম গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি। আট ঘণ্টার শিফট। দুই হাজার টাকা বেতন।”
আম্মু অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে সুলতানার দিকে তাকিয়ে রইলেন, কিছুক্ষণ চেষ্টা করে বললেন, “দু-দুই হাজার টাকা?”
“জে।”
“কেমন করে পেলি?”
সুলতানা এবারে কোনো কথা বলল না। আম্মু তখন রেগে গেলেন, “কেমন করে পেলি? বাড়ি এসে তোকে চাকরি দিয়ে গেছে?”
সুলতানা মাথা নাড়ল।
আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “তা হলে?”
“যেদিন বাজারে গিয়েছিলাম সেদিন ইন্টারভিউ দিছি।”
“রূপা তোর সাথে ছিল না?”
সুলতানা রূপাকে বাঁচানোর চেষ্টা করল, বলল, “রূফা জানে না। পোস্টার কাগজ কিনতে গেছিল আমি তখন দিছি।”
আম্মু চোখ লাল করে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর একটা অত্যন্ত বিচিত্র ব্যাপার ঘটল। আম্মু হঠাৎ তার গলায় একেবারে মধু ঢেলে বললেন, “পাগলি মেয়ে! তোর নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ভদ্রঘরের মেয়েরা কখনো গার্মেন্টসে কাজ করতে যায়?”
আম্মুর গলার স্বর শুনে সুলতানা একেবারে ভড়কে গেল, অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল, কোনো কথা বলল না। আম্মু গলায় আরও মধু ঢেলে বললেন, “তুই গার্মেন্টসে কাজ করতে যাবি, কোথায় থাকবি, কী খাবি, কখন কোন বিপদে পড়বি, আমি কী শান্তিতে থাকতে পারব? আমার একটা দায়িত্ব আছে না?”
সুলতানা এবারেও কিছু বলল না। আম্মু মুখে আঠা-আঠা এক ধরনের হাসি ফুটিয়ে বললেন, “মাথা থেকে এই সব পাগলামি চিন্তা ঝেড়ে ফেল মা! এইখানে থাকতে তোর কষ্ট কীসের? নিজের বাড়ি মনে করে থাকবি। আমরা কী তোর নিজের ফ্যামিলির মতো না? আমাদের ছেড়ে তুই চলে যেতে পারবি?”
সুলতানা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল আম্মু তাকে বলতে দিলেন না। হাত নেড়ে থামিয়ে দিয়ে আহ্লাদী স্বরে নেকি নেকি গলায় বললেন, “আমি তোর কোনো কথা শুনব না। তুই আমার ফ্যামিলির, তোকে আমি যেতে দিব না। তুই এখানে থাকবি।”
সুলতানা আবার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, আম্মু আবার হাত নেড়ে তাকে থামিয়ে দিলেন, বললেন, “যা এখন। একটু চা বানিয়ে আন, আমার জন্যে এক কাপ। তোর নিজের জন্যে এক কাপ!”
রাতেরবেলা আরো ভয়ংকর ব্যাপার ঘটল, আম্মু-আব্বু, তিয়াশা আর মিঠুন মিলে যখন হিন্দি সিরিয়াল দেখছে তখন আম্মু মধুর গলায় ডাকলেন, “সু-ল-তা-না!”
সুলতানা ছুটে এলো, “জি খালাম্মা।”
“তুই কী করছিস?”
“তরকারি গরম করছি।”
“পরে করবি। এখন এখানে বস।”
সুলতানা ঢোক গিলে বলল, “বসব?”
“হ্যাঁ, আমাদের সাথে এই সিরিয়ালটা দেখ। অসাধারণ। নায়কের নাম জাসিন্দর, একটিং দেখলে তোর চোখে পানি এসে যাবে।”
সুলতানা শুকনো গলায় বলল, “আমার দেখতে হবে না খালাম্মা। হিন্দি কথা আমি বুঝি না।”
“বুঝবি না কেন? একেবারে বাংলার মতোন। একটু শুনলেই সব বুঝতে পারবি।”
“ভাত-তরকারি গরম করতে হবে। সালাদ কাটতে হবে–”
“পরে করবি। এখন এইখানে বস। বসে দেখ কী অসাধারণ একটিং।”
আম্মু জোর করে সুলতানাকে বসালেন, সুলতানা কাঠ হয়ে বসে রইল।
.
ভোরবেলা রূপা, তিয়াশা আর মিঠুন স্কুলে চলে যাবার পর সুলতানা আবার আম্মুর কাছে এলো। বলল, “খালাম্মা, আমারে বিদায় দেন, আমি যাই। আজকে গার্মেন্টসে আমার কাজ শুরু করার কথা।”
আম্মুর চোখ ধক করে জ্বলে উঠল। অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে বললেন, “তোকে না বলেছি না যেতে।”
“আমারে যেতে হবে খালাম্মা। আমি আর বাসায় কাম করতে চাই না।”
“বাসায় কাজ করতে চাস না?”
“না খালাম্মা।”
“আমার কী হবে? বাসা কেমন করে চলবে?”
“আপনি কাউকে পেয়ে যাবেন খালাম্মা।”
আম্মু হিংস্র মুখে তাকালেন, “তুই আমার সাথে নিমকহারামি করবি?”
“এইটা নিমকহারামি না খালাম্মা। আমি একটা ভালো সুযোগ পাইছি, সেই সুযোগটা নিতে চাই। আপনি আমার জন্যে দোয়া করে দেন।”