সুলতানা যখন একজন বদরাগী মহিলাকে দেখে হাসতে শুরু করতে যাচ্ছিল, রূপা তাকে থামাল, বলল, “সুলতানা, তুমি যখন একা একা বাজারে যাও তখন এইভাবে সবকিছু দেখে হাস? হাসতে হাসতে যাও?”
সুলতানা বলল, “ধুর। মানুষ কী:একা একা হাসতে পারে? একা একা হাসলে মানুষ পাগল বলবে না?”
“আজকে সাথে আমি যাচ্ছি সেই জন্যে এত হাসছ?”
সুলতানা মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ। সেইটা সত্যি।”
“তোমার হাসতে ভালো লাগে?”
“হ্যাঁ। আমি যখন গেরামে থাকতাম দিন-রাত হাসতাম। আমার মায়ে বলত আমারে জিনে পাইছে!”
রূপা বলল, “সেইটা মনে হয় তোমার মা ঠিকই বলত। তোমারে মনে হয় আসলেই জিনে পেয়েছে।”
“বাসায় যখন থাকি তখন তো হাসতে পারি না, আজকে বাইরে এসে তাই একটু হাসি-তামাশা করছি।”
“ভালো।” রূপা বলল, “যারা বেশি হাসে তাদের অসুখ-বিসুখ হয় না, বেশিদিন বাঁচে।”
“সর্বনাশ! তা হলে আমার এক্ষুনি হাসা বন্ধ করা দরকার।”
“কেন? তুমি বেশিদিন বাঁচতে চাও না?”
“আমার মতো মানুষ বেশিদিন বেঁচে কী করবে? বেশিদিন বাঁচবে তোমাদের মতো মানুষ।” বলে সুলতানা একটু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল।
তারা দুইজন কোনো কথা না বলে পাশাপাশি কিছুক্ষণ হেঁটে যায়। একসময় সুলতানা মুখ তুলে তাকাল, রাস্তার অন্যপাশে একটা বিল্ডিং, সেখানে অনেক মানুষের ভিড় বেশিরভাগই কমবয়সী মেয়ে। দেখে বোঝা যায়, মেয়েগুলো গরিব ফ্যামিলির। সুলতানা বলল, “এতগুলা শুকনা শুকনা মেয়ে এইখানে কীসের মিটিং করে?”
“জানি না।”
“কোনো কামকাজ নাই, সকালে এসে রাস্তার মাঝে হইচই!”
রূপা তাকিয়ে দেখল বিল্ডিংয়ের উপর বড় বড় করে লেখা জানে আলম গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি-এই মেয়েগুলো নিশ্চয়ই গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। সে মাথা নাড়ল, বলল, “গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি। এরা এখানে কাজ করে।”
সুলতানা ভুরু কুঁচকে বলল, “যদি কাজ করে তা হলে ভেতরে ঢুকে না। কেন?”
“ঢুকবে। দরজা খুললেই ঢুকবে।”
“উঁহু। এরা কাজ করে না। কাজ করলে পোলাপান নিয়ে আসত না।”
রূপা তাকিয়ে দেখল সুলতানার কথা সত্যি, অনেক মেয়ে, অনেক মহিলা অনেকের কোলে বাচ্চাকাচ্চা। মেয়ে আর মহিলারা লাইনে দাঁড়ানোর জন্যে ঠেলাঠেলি করছে। হঠাৎ করে রূপার একটা কথা মনে হল, হয়তো আজকে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে লোক নেবে-সবাই চাকরির জন্যে ইন্টারভিউ দিতে এসেছে। রূপা রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে গেল, সুলতানা বলল, “কী হল?”
“চলো দেখে আসি।”
“কী দেখবা?”
“ওখানে কী হচ্ছে।” সুলতানা কিছু বলার আগে রূপা রাস্তা পার হয়ে এগিয়ে গেল, ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মহিলাকে জিজ্ঞেস করল, “এখানে কী হচ্ছে?”
“গার্মেন্টসে লোক নিবে।”
“তার ইন্টারভিউ?”
মহিলাটা মাথা নাড়ল। রূপা জিজ্ঞেস করল, “ইন্টারভিউ দিতে হলে কী করতে হবে?”
মহিলাটা রূপার মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে বলল, “এইখানে লাইনে দাঁড়াতে হবে।”
“আর কিছু লাগে?”
“না। গায়ে-গতরে জোর থাকা লাগে। পেটে ভুখ থাকা লাগে আর কিছু লাগে না।”
সুলতানা ততক্ষণে হেঁটে রূপার কাছে এসেছে। জিজ্ঞেস করল, “কী হল?”
রূপা কিছুক্ষণ সুলতানার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “সুলতানা।”
“কী?”
”ইন্টারভিউ দেবে?”
সুলতানা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, “কী করব?”
“গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে লোক নিচ্ছে। তুমি ইন্টারভিউ দিতে চাও?”
“আমি?” সুলতানা ভাবল রূপা ঠাট্টা করছে তাই ঠাট্টার উত্তর দেবার মতো করে হি হি করে হাসল।
রূপা মুখ শক্ত করে বলল, “আমি কিন্তু ঠাট্টা করছি না। সিরিয়াসলি বলছি।”
এবারে সুলতানা অবাক হয়ে রূপার দিকে তাকাল বলল, “তুমি সত্যি বলছ?”
“হ্যাঁ। আমি সত্যি বলছি। বাসায় তোমাকে যত কষ্ট করতে হয় তার কোনো মানে নাই। গার্মেন্টসে কাজ করলে তুমি স্বাধীনভাবে থাকতে পারবে।”
“স্বাধীনভাবে?”
“হ্যাঁ। বাসার কাজে কোনো সম্মান নাই। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তোমাকে কাজ করতে হয়। আম্মু তোমাকে খালি বকে না, তোমার গায়ে হাত পর্যন্ত তুলে। তোমার এখানে থাকা ঠিক না।”
সুলতানা খানিকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে রূপার দিকে তাকিয়ে রইল। রূপা বলল, “তুমি লাইনে দাঁড়িয়ে ইন্টারভিউ দাও।”
সুলতানা এতক্ষণে নিজেকে একটু সামলে নিয়েছে, একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, “বলা খুব সোজা।”
“কেন? বলা সোজা কেন?”
লাইনে কতক্ষণ দাঁড়াতে হবে তুমি জান? তারপর বাসায় গেলে খালাম্মা আমারে আস্ত রাখবে?”
রূপা বলল, “তুমি বাজারের জিনিসটা আমারে দাও। আমি বাজার করে আনি। তুমি এইখানে দাঁড়াও, ইন্টারভিউ দাও।”
সুলতানা হি হি করে হাসল, বলল, “তুমি বাজার করবে?” তা হলেই হইছে।”
“কেন? আমি দুই-তিনটা জিনিস কিনতে পারব না?”
সুলতানা লম্বা লাইনটার দিকে তাকাল তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “নাহ্! এই লাইন অনেক লম্বা। রাত পোহায়ে যাবে।”
রূপা প্রথম যে মহিলার সাথে কথা বলেছিল সে কাছেই দাঁড়িয়ে তাদের কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল সে হঠাৎ করে সুলতানাকে বলল, “তুমি চাইলে আমার সামনে দাঁড়াতে পার। তা হলে বেশিক্ষণ লাগবে না।”
সুলতানা বলল, “আপনার সামনে দাঁড়াব?”
“হ্যাঁ।”
রূপা বলল, “যারা পিছনে আছে তারা রাগ হবে না?”
“কিছু রাগ তো হবেই। এত রাগ-গোসা দেখলে হয়?”
“কিন্তু কাজটা কী ঠিক হবে? লাইন ভেঙে সামনে–”
“বেঁচে থাকতে হলে ঠিক-বেঠিক সব কাজ করতে হয়।” মহিলা সুলতানার দিকে তাকিয়ে বলল, “খাড়াও।”