রূপা হাসার ভান করল, “সত্যিকারের বোমা না আম্মু। ধোঁয়ার বোমা।”
“তারপরেও তো বোমা। স্কুলে বোমা বানানো শেখায়?”
রূপা বলল, “বোমা না আম্মু। এখান থেকে গলগল করে ধোয়া বের হবে। এটা ভয়ের না, মজার।”
আম্মু অপছন্দের ভঙ্গি করে মাথা নাড়লেন। রূপা বলল, “সবাইকে কিছু না কিছু বানাতে হবে। সবার আব্বু-আম্মুকে দাওয়াত দেওয়া হবে।”
আম্মু বললেন, “অ–”
রূপা এবারে তার আসল কথায় এলো, কাচুমাচু করে বলল, “আমাদের এই প্রজেক্টটা বানানোর জন্যে কিছু কেমিক্যাল কিনতে হবে। সেই জন্যে কিছু টাকা লাগবে আম্মু।”
“টাকা!” আম্মু রীতিমতো চমকে উঠলেন, তার গলার স্বর শুনে মনে হল টাকা নয় রূপা যেন মানুষ খুন করার কথা বলেছে।
“হ্যাঁ আম্মু। আমার একটু টাকা লাগবে।”
কত টাকা লাগবে আম্মু সেটা জানতেও চাইলেন না। জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললেন, “টাকা কী গাছে ধরে? এইসব পোলাপানের খেলাধুলার জন্যে টাকা নষ্ট করত হবে?”
রূপা প্রায় মরিয়া হয়ে বলল, “আম্মু এটা পোলাপানের খেলাধুলা না–এটা সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট!”
“তুই যখন সায়েন্স পড়বি না তা হলে সায়েন্স নিয়ে এত নাটক-ফাটক করা শুরু করেছিস কেন?”
রূপা চোখ কপালে তুলে বলল, “কে বলেছে আমি সায়েন্স পড়ব না?”
আম্মু মুখে একটু খাবার তুলে বললেন, “এর মাঝে আবার বলাবলির কী আছে? কেউ এখন সায়েন্স পড়ে না।”
“কে বলেছে সায়েন্স পড়ে না? সব ভালো ছাত্র-ছাত্রীরা সায়েন্স পড়ে। আমিও পড়ব।
“শুধু যারা গাধা তারা সায়েন্স পড়ে।”
“গাধা?”
“হ্যাঁ। দশজন প্রাইভেট টিউটর লাগে। ছয়টা কোচিং সেন্টার লাগে। তাই বড়লোকেরা সায়েন্স পড়ে। এইটা হচ্ছে বিলাসিতা।”
“কী বলছ আম্মু?”
“মাথার মাঝে ঐ সব বড়লোকী চিন্তা আনবি না। অন্য দশজন যা করে তুইও তাই করবি। কমার্স পড়বি।”
“না আম্মু, আমি সায়েন্স পড়ব।”
আম্মু চোখ পাকিয়ে বললেন, “ কী বললি? সায়েন্স পড়বি?”
“হ্যাঁ আম্মু।”
“তোর শখ দেখে আমি বাঁচি না!” আম্মু বিদ্রুপের হাসির মতো একটা শব্দ করলেন, তারপর মুখ শক্ত করে বললেন, “এই বাসায় কেউ সায়েন্স পড়তে পারবে না। দেখি তুই কেমন করে সায়েন্স পড়িস। এই বাসায় যদি থাকতে চাস তা হলে আমরা যেটা বলি তোকে সেটা করতে হবে। বুঝেছিস?”
কথা বলে কোনো লাভ নেই তাই রূপা কোনো কথা বলল না। একটা বড় নিশ্বাস ফেলে একটু পরে বলল, “আর আমার সায়েন্স প্রজেক্টের জন্যে টাকাটা?”
“ভুলে যা। এতো সহজে টাকা গাছে ধরে না।”
রূপার চোখে পানি চলে এলো, সে মাথা নিচু করে ফেলল যেন কেউ দেখতে না পায়।
সবাই ঘুমিয়ে যাবার পরও রূপা জেগে রইল। কাল স্কুলে গিয়ে কী বলবে সেটা ভেবে পাচ্ছিল না। তার কোনো একটা কিছু আছে কী না যেটা সে বিক্রি করতে পারে সেটা চিন্তা করছিল তখন মশারির পাশে একটা ছায়ামূর্তি দেখতে পেল, মাথা নিচু করে ফিসফিস করে বলল, “রফ-রূফালী? ঘুম?” সুলতানার গলার স্বর!
“না এখনও ঘুমাইনি।”
“এই যে নাও।” বলে সুলতানা মশারির ভেতর দিয়ে তার হাতটা ঢুকিয়ে তাকে কিছু একটা দেওয়ার চেষ্টা করল।
রূপা জিজ্ঞেস করল, “কী?”
“টাকা। আমার এখন দরকার নাই। তুমি রাখ। পরে দিয়ে দিও।”
রূপা বলতে গেল, না না, লাগবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলল না, টাকাগুলো নিয়ে বলল, “থ্যাংকু। আমি সামনের মাসে স্কলারশিপের টাকা পেলে দিয়ে দেব।”
সুলতানা ফিসফিস করে বলল, “কোনো তাড়াহুড়া নাই।”
.
১১.
সুলতানা হি হি করে হেসে বলল, “দেখো দেখো ছ্যামড়াটারে দেখো!”
রূপা তাকিয়ে দেখল, রাস্তার পাশে গাবদা-গোবদা একটা ছোট বাচ্চা বসে আছে। খালি পা, পেট মোটা, গলায় তাবিজ, মাথা ন্যাড়া এবং মুখে দর্শনিকের মতো একটা উদাসীন ভাব। এই বাচ্চাটাকে দেখে এভাবে হাসিতে গড়িয়ে পড়ার কিছু নেই কিন্তু সুলতানা হাসতে হাসতে খুন হয়ে গেল। হাসি মনে হয় সংক্রামক এবং একটু পর রূপাও হি হি করে হাসতে লাগল। সে ছোট বাচ্চাটিকে জানাতেও পারল না যে, তার শিশু মুখে নিপাট গাম্ভীর্য দেখে দুইজন হাসিতে ভেঙে পড়েছে।
সুলতানা সামনে এগিয়ে গিয়ে পিছনে তাকিয়ে বাচ্চাটাকে দেখতে দেখতে বলল, “কি মায়া লাগে, তাই না রূফ-রূফালী?”
রূপা মাথা নাড়ল, ছোট বাচ্চা দেখলেই সুলতানার মায়া লাগে, তার মনটা খুব নরম।
আরেকটু এগিয়ে একটা ছাগলকে দেখে সুলতানা আবার হাসিতে ভেঙে পড়ল। বলল, “দেখো দেখো-বেকুব ছাগলটারে দেখো। রাস্তার মাঝখানে খাড়ায়া কাঁঠাল পাতা খায়।”
রূপা আগে কখনো ছাগল দেখে হাসেনি, কিন্তু তাকে স্বীকার করতেই হল, একটা ব্যস্ত রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে যদি একটা ছাগল গম্ভীরভাবে কাঁঠাল পাতা চিবুতে থাকে তা হলে তার মাঝে একটু কৌতুকের চিহ্ন থাকতে পারে। আরেকটু এগিয়ে সুলতানা যখন একটা মোটা মানুষকে দেখে একটু বিপজ্জনকভাবে হাসতে শুরু করল তখন রূপা বুঝতে পারল যে আসলে সুলতানার মনটার মাঝে ফুরফুরে আনন্দ তাই সে কারণে-অকারণে হাসছে।
সুলতানা চব্বিশ ঘণ্টা বাসার ভেতরে আটকে থাকে, তার শুক্র-শনিবার নেই, ছুটিছাটা নেই, রাতের কয়েক ঘণ্টা ঘুম ছাড়া বাকি সময়টা তাকে একটানা কাজ করতে হয়। একজন মানুষের পক্ষে এত কাজ করা সম্ভব সেটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। তার জীবনে আনন্দের কিছু নেই। হঠাৎ হঠাৎ করে সে বাসার বাইরে যাবার সুযোগ পায় যখন আম্মু খুব বিশেষ একটা কারণে তাকে বাজার করতে পাঠান। আজকে সেরকম একটা দিন, বাসায় হঠাৎ করে কিছু জিনিস শেষ হয়ে গেছে তাই আম্মু সুলতানাকে বাজারে পাঠিয়েছেন। ঠিক যখন সুলতানা বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে বের হয়েছে তখন রূপার মনে হয়েছে তারও একটু দোকানে যাওয়া দরকার পোস্টার পেপার কেনার জন্যে। আম্মু সুলতানার সাথে যেতে আপত্তি করেননি তাই দুইজন একসাথে বাইরে।