রূপা রাজুর কাছে শুনেছিল তার আম্মু কী একটা মহিলা সংগঠনে কাজ করেন। কয়দিন থেকে ভাবছিল তার সাথে সুলতানার ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করবে। এখন তার একটা চেষ্টা করা যায়। সে বলল, খালাম্মা, আমাদের বাসায় একটা মেয়ে কাজ করে, তার নাম সুলতানা। বেচারি সুলতানার ফ্যামিলির খুব অভাব-অনেক বড় ফ্যামিলি। কিছুতেই বেচারি টাকা জমাতে পারছে না। বাড়ি পর্যন্ত যেতে পারে না।
রাজুর আম্মু কিছুক্ষণ রূপার দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপরে বললেন, “আমাদের দেশের কাজের মানুষের সমস্যা অনেক বড় সমস্যা। তারা চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করে, তাদের কোনো ছুটি নেই। অল্প কিছু বেতন পায় অনেক ফ্যামিলিতে ‘অত্যাচার করে কিন্তু কেউ সেটা দেখে না। দেশে তাদের জন্যে কোনো আইন নেই। তুমি এত ছোট একটা মেয়ে এদের ব্যাপারটা লক্ষ করেছ, সেটা খুব চমৎকার। কংগ্রাচুলেশনস।”
“ওদের জন্যে কী করা যায় খালাম্মা?”
“সবচেয়ে সহজ হচ্ছে বাসার কাজ থেকে সরিয়ে অন্য কোনো কাজে লাগিয়ে দেওয়া। বাসার কাজে তো কোনো সম্মান নেই। সত্যিকার কাজে সম্মান আছে।”
“কী ধরনের কাজ?”
“যাদের লেখাপড়া নেই, ট্রেনিং নেই তাদের জন্যে তো সুযোগ খুব বেশি নেই! গার্মেন্টসের কাজ হতে পারে। বড় বড় শহরে বিশাল বিশাল গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি, এখানে সেরকম নেই। কিন্তু একটা-দুইটা আছে।
“রূপা আগ্রহ নিয়ে বলল, এরকম একটা গার্মেন্টসে কী সুলতানা কাজ করতে পারবে?”
“বয়স কত?”
“আমার মতো।”
“তা হলে তো অনেক ছোট।”
“আরেকটু বড়ও হতে পারে।”
“যাই হোক শিশু শ্রমের ব্যাপার আছে। তারপরেও চেষ্টা করতে পারি। তুমি জিজ্ঞেস করে দেখ, যদি রাজি থাকে তা হলে বল। আমার পরিচিত কিছু গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি আছে।”
“বলব। খালাম্মা, আপনাকে বলব।”
.
১০.
বিজ্ঞান ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের কী খবর?”
ক্লাশের ছেলেমেয়েরা বলল, “ভালো ম্যাডাম। খুব ভালো।”
“ভেরি গুড। তোমাদের বিজ্ঞান প্রজেক্ট কেমন এগোচ্ছে?”
এবারে ক্লাসের ছেলেমেয়েদের ভেতর থেকে নানা ধরনের উত্তর শোনা গেল। কিছু জোরে, কিছু আস্তে, কিছু উৎসাহের, কিছু হতাশার, কিছু আনন্দের এবং কিছু দুঃখের। ম্যাডাম সবকিছু বুঝে ফেলার ভঙ্গি করে মাথা নাড়লেন, বললেন, “বুঝেছি।”
মাসুক জিজ্ঞেস করল, “কী বুঝেছেন ম্যাডাম?”
“তোমাদের চাপ দিতে হবে। তা না হলে তোমরা প্রজেক্ট শেষ করবে না।”
“চাপ?”
“হ্যাঁ। একটা ডেডলাইন দিতে হবে।” ম্যাডাম মনে মনে কী একটা হিসাব করলেন তারপর বললেন, “তোমাদের এক সপ্তাহ সময় দিলাম, পরের শুক্রবার সায়েন্স ফেয়ার।”
ক্লাসের অনেকেই চমকে উঠল, “পরের শুক্রবার? এত তাড়াতাড়ি?”
“হ্যাঁ। এত তাড়াতাড়ি। তার কারণ এইটা শেষ হবার পর আরেকটা প্রজেক্ট হবে তারপর আরেকটা তারপর আরেকটা এভাবে চলতেই থাকবে! বুঝেছ?”
“বুঝেছি ম্যাডাম।”
“এবারে সবার প্রগ্রেস রিপোর্ট শুনি।” ম্যাডাম ব্যাগ থেকে কাগজ বের করলেন, “প্রথমে হচ্ছে টিম দুর্বার। টিম দুর্বার তোমরা বল তোমাদের কাজ কতদূর অগ্রসর হয়েছে?”
টিম দুর্বারের সদস্যদের খুব দুর্বার মনে হল না, মুখ কাচুমাচু করে জানাল সৌর বিদ্যুৎ প্রজেক্টের জন্যে তাদের সোলার প্যানেল আর ব্যাটারি জোগাড় করার কথা, এখনো জোগাড় হয়নি তাই প্রজেক্ট থেমে আছে। ম্যাডাম তখন কীভাবে সোলার প্যানেল, ব্যাটারি এসব জোগাড় করা যায় সেটা বলে দিলেন।
এরপরের টিমের নাম টিম গ্যালিলিও, তাদের একটা টেলিস্কোপ তৈরি করার কথা। তারা জানাল টেলিস্কোপ একটা তৈরি হয়েছে কিন্তু এখনো দুটি সমস্যা। প্রথমত, সবকিছু ঝাঁপসা দেখা যায় এবং উল্টো দেখা যায়। তাদের কথা শুনে ক্লাসের অনেকে হেসে উঠলেও ম্যাডাম হাসলেন না, ঝাঁপসাকে কেমন করে পরিষ্কার করা যায় আর উল্টোকে কেমন করে সিধে করা যায় সেটা বলে দিলেন।
এর পরের টিমের নাম টিম রোবটিক্স, টিম লিডার মাসুক। তার উৎসাহের শেষ নেই কিন্তু তার টিমের অন্য মেম্বারদের কেমন যেন নেতিয়ে পড়া ভাব। মাসুক বলল, “ম্যাডাম আমরা আমাদের প্ল্যানটা একটু অন্যরকমভাবে করেছি।”
“কী রকম করেছ?”
“সত্যিকারের রোবট বানানো তো সোজা না, এক সপ্তাহের মাঝে তৈরি করা যাবে না, তাই আমরা ঠিক করেছি আমরা নিজেরাই রোবট সেজে ফেলব। কার্ডবোর্ড কেটে মাথার মাঝে লাগিয়ে রোবটের ভাষায় কথা বলব।”
বিজ্ঞান ম্যাডাম কেমন যেন হকচকিয়ে গেলেন, “রোবটের ভাষা? সেটা কী রকম?”
মাসুক তখন নাক দিয়ে কাটা কাটা এক ধরনের যান্ত্রিক শব্দ করল। সেটা শুনে ক্লাশের সবাই হেসে উঠল এবং ম্যাডাম আরেকটু হকচকিয়ে গেলেন, একটু ইতস্তত করে বললেন, “রোবট বানানো আর রোবট সাজা কিন্তু এক ব্যাপার না।”
রোবট বানানোটা ধর বিজ্ঞানের কাজকর্ম হতে পারে, কিন্তু রোবট সাজাটা হবে নাটক-থিয়েটারের কাজকর্ম।”
মাসুককে এবারে একটু হতাশ দেখা গেল, বলল, “রোবট বানানো খুবই কঠিন। ইন্টারনেটে একটু দেখেছিলাম কিছুই বুঝি না।”
ম্যাডাম বললেন, “পৃথিবীর কোনো জিনিসই কঠিন নয়। একসাথে পুরোটা কঠিন মনে হতে পারে কিন্তু সেটাকে যদি ছোট ছোট অংশে ভাগ করে নাও দেখবে কোনোটাই কঠিন নয়। কাজেই পুরো রোবট একবারে তৈরি না করে রোবটের একটা অংশ তৈরি কর। হাতের মডেল কিংবা একটা আঙুল।”