“ছেড়ে দেব? এই হারামজাদিকে ছেড়ে দেব?” আম্মু চিৎকার করে বললেন, “কি করেছে দেখেছ? সবকিছু পুড়িয়ে শেষ করেছে। আরেকটু হলে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিত।”
“যাই হোক, আগুন তো লাগেনি।”
“তুমি এদের চেনো না। এরা হচ্ছে ছোটলোকের জাত। এদের রক্তের মাঝে দোষ আছে। এদের লাই দিলে এরা মাথায় ওঠে। এদের জুতো দিয়ে পিটিয়ে সিধে রাখতে হয়।”
গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে গেল তখন রূপা চুপি চুপি রান্নাঘরে গেল। সুলতানা মেঝেতে বসে আছে, হাত দিয়ে মেঝেতে আঁকিবুকি কাটছে। রূপা ফিসফিস করে ডাকল, “সুলতানা।”
সুলতানা কোনো কথা না বলে মাথা তুলে তাকাল। রূপা বলল, “তুমি মন খারাপ করো না। আমি আমি–”
“তুমি কী?”
“আমি যখন বড় হব তখন আমি তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাব। তুমি আর আমি থাকব। তখন তোমার কোনো কষ্ট থাকবে না।”
সুলতানা হাসার চেষ্টা করল। ঠোঁটটা ফেটে গেছে তাই হাসার চেষ্টা করার সময় এক ফোঁটা রক্ত বের হয়ে এলো। রূপা বলল, “তুমি বিশ্বাস করছ না আমার কথা?” সুলতানা মাথা নাড়ল, বলল, “করেছি।” তোমার কথা বিশ্বাস করি দেখেই তো আমি বেঁচে আছি। তা না হলে কী আর বেঁচে থাকতাম? আমার কী খুব বেঁচে থাকার সখ?”
০৯-১২. ফোনটা লাউড স্পীকার মোডে আছে
মোবাইল ফোনটা মাঝখানে রেখে চারজন সেটার চারদিকে বসে আছে। ফোনটা লাউড স্পীকার মোডে আছে তাই যে কথাই আসুক সেটা চারজনে শুনতে পাবে। এই মোবাইল ফোনটা রাজুর বড় বোন মিথিলার। এই মুহূর্তে মিথিলার ফোনটা থেকে তিয়াশার ফোনে ডায়াল করা হয়েছে। তিয়াশার ফোনটা রয়েছে ড্রাগ ডিলারদের চায়ের দোকানে। সেখানে কোনো কথাবার্তা হলে তারা এখানে বসে শুনতে পাবে-সেটাই ছিল পরিকল্পনা।
পরিকল্পনাটা কাজে লাগবে না সেটা তারা বুঝতে শুরু করেছে। প্রথম কারণ হচ্ছে টাকা-পয়সা, মিথিলার ফোনে শ খানেক টাকা ছিল সেই টাকাটা ধীরে ধীরে খরচ হয়ে যাচ্ছে। যখন পুরো টাকা খরচ হয়ে যাবে তখন লাইন কেটে যাবে–কাজেই এই সময়ের ভিতরে যদি কোনো কথাবার্তা না হয় তা হলে তারা সেটা শুনতে পাবে না। দ্বিতীয় কারণটা হচ্ছে ফোনটার অবস্থান। তারা অনেক বুদ্ধি করে ফোনটার উপরে শক্ত টেপ দিয়ে ফ্যাসেনার লাগিয়েছে। সেই ফ্যাসেনারের অন্য অংশ আছে চায়ের দোকানের বেঞ্চের নিচে। সেগুলো দিয়ে তিয়াশার ফোনটা বসানো হয়েছে বেঞ্চের নিচে। বেঞ্চে কেউ বসলে নাড়াচাড়া করলে তারা সেই শব্দ স্পষ্ট শুনতে পায় কিন্তু যখন কেউ কথা বলে সেটা অস্পষ্ট শোনা যায়। তারপরেও তারা যে কথাবার্তা একেবারেই শুনতে পায় না তা না। মাঝে মাঝেই একটা-দুইটা কথা শুনতে পায় কিন্তু সেই কথাগুলো খুবই সাধারণ কথা, কেউ একজন এসে চায়ের অর্ডার দিচ্ছে, সিঙ্গারা কিনছে, সিগারেট কিনছে এরকম।
সবচেয়ে দুশ্চিন্তায় আছে রূপা। যদি দোকানের লোকগুলো কোনোভাবে ফোনটা খুঁজে পেয়ে যায় তা হলে মহা বিপদ হয়ে যাবে। তিয়াশার ফোনটা তা হলে তারা আর ফেরত পাবে না, তখন তিয়াশাকে কী জবাব দেবে সেটা সে চিন্তাও করতে চায় না। রূপা তাই একটু পরে পরে ঘড়ি দেখছিল, মোবাইলের টাকা শেষ হবার পর চায়ের দোকানের বেঞ্চের নিচ থেকে মোবাইল ফোনটা উদ্ধার না করা পর্যন্ত সে শান্তি পাচ্ছে না।
মোবাইল ফোনটায় তখন একটু কথা শোনা গেল, চারজনই তখন কান পাতল। কথাগুলো খুব আস্তে কিন্তু তারপরেও বোঝা যাচ্ছে। একজন বলল, “আজকে কিন্তু বড় ডেলিভারি।”
আরেকজন বলল, “ঠিক আছে।” গলার স্বর শুনে মনে হল চায়ের দোকানদার।”আপনারা বুঝছেন তো আমার কত বড় রিক্স।”
“কীসের রিক্স?”
“পুলিশের।”
“পুলিশের কোনো রিক্স নেই। আমরা মাসে মাসে টাকা দেই না!”
“সব পুলিশকে টাকা দিয়ে কেনা যায় না। কিছু ত্যাড়া পুলিশ থাকে।” দোকানদার বলল, “আপনাদের এত বড় বড় ডেলিভারির জন্যে আমার এই ভাঙাচুরা দোকান ব্যবহার করেন–আমার ভয় লাগে।”
“ভয় নেই। আমরা আছি না?”
“জে আছেন।”
“শোনো তা হলে, খুব বড় ডেলিভারি। এক পার্টি তোমারে ডেলিভারি দিব। তুমি মাল তোমার কাছে রাখবা। তোমারে মাল ডেলিভারি দিবার সময় বলবে মিঠা পানি, লুনা পানি। বুঝেছ?”
“বুঝেছি। মিঠা পানি, লুনা পানি।”
“হ্যাঁ, আর তোমার কাছ থেকে আরেক পার্টি সেই মাল নিয়ে যাবে।”
“কখন?”
“আজকেই নেবে।”
“কে আসবে?”
“সেইটা কী তোমারে বলে দেব? বলব না। গোপন পার্টি। দেখে বুঝতেই পারবে না। কিন্তু তার কথা শুনে বুঝবে সে গোপন পার্টি।”
“কী কথা বলবে?”
“বলবে গিলা-কলিজার বাটি।”
“গিলা-কলিজার বাটি? হে হে হে!”
“হ্যাঁ। হাসির কিছু নেই। গোপন কথা–গোপন।”
“ঠিক আছে। কেউ এসে যদি বলে গিলা-কলিজার বাটি তারে আমি মাল দিয়ে দেব?”
“হ্যাঁ। যদি সন্দেহ হয় তা হলে বলবে পরিষ্কার করে বলেন। তখন সে বলবে, বরফের মতো গরম আগুনের মতো ঠাণ্ডা। বুঝেছ?”
“বরফের মতো গরম?”
“হ্যাঁ, আর আগুনের মতো ঠাণ্ডা। মনে থাকবে?”
“মনে থাকবে।”
“আরেকটা বিষয়। খুব জরুরি–” মানুষটা যখন খুব জরুরি কথাটা বলতে শুরু করল ঠিক তখন লাইনটা কেটে গেল। মিথিলার ফোনের টাকা শেষ।
ওরা চারজন একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। রাজু চোখ বড় বড় করে বলল, “দেখেছ? ড্রাগ ডিলাররা কেমন করে কাজ করে?”
সঞ্জয় বলল, “হ্যাঁ। গোপন পাসওয়ার্ড!”
মিম্মি বলল, কী আজব। গিলা-কলিজার বাটি! এইটা একটা পাসওয়ার্ড হল? ভালো কিছু বলতে পারে না?”