মিম্মি জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু কী?”
“সোজা পথে না দিলে বাঁকা পথে চেষ্টা করলে দোষ কী?”
সঞ্জয় মাথা নাড়ল, “কোনো দোষ নেই। সোজা পথে সময় নষ্ট করে কোনো লাভ নেই, বাঁকা পথে যা।”
.
০৮.
তিয়াশা যখন বাথরুমে গেল তখন রূপা তিয়াশার ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে সেটা খুলে ব্যাটারি বের করল। তারপর ছোট এক টুকরো স্কচ টেপ ব্যাটারির ধাতব টারমিনালে লাগিয়ে আবার ব্যাটারিটা ভেতরে ঢুকিয়ে মোবাইল ফোনটা বন্ধ করে তিয়াশার ব্যাগে রেখে দিল। এখন চেষ্টা করলেও মোবাইল ফোনটা আর চালু করা যাবে না।
তিয়াশা সেটা লক্ষ করল ঘণ্টা দুয়েক পর। মোবাইল ফোনটা কয়েকবার টেপাটেপি করে বলল, ‘আরে! আমার মোবাইল ফোনটা অন হয় না কেন?”
রূপা শুনেও না শোনার ভান করে চোখের কোনা দিয়ে তিয়াশাকে লক্ষ করতে লাগল। তিয়াশা ফোনটা কয়েকবার ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “কী হল! কী মুশকিল!”
এবারে রূপা বলল, “কী হয়েছে?”
“আমার মোবাইল! অন হচ্ছে না।”
“চার্জ শেষ। চার্জ কর। তা হলেই চালু হবে।”
“উঁহু। পুরা চার্জ ছিল।”
“তা হলে তোমার টাকা শেষ।”
তিয়াশা বিরক্ত হয়ে বলল, “টাকা শেষ হলে ফোন অফ হবে কেন?”
“দেখি আমার কাছে দাও দেখি!” রূপা তিয়াশার হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করল। ব্যাটারিটা বের করল, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখল তারপর আবার ভেতরে ঢুকিয়ে টেপাটেপি করে হাল ছেড়ে দেওয়ার ভান করে বলল, “নাহ! কিছু একটা গোলমাল হয়েছে।”
“এখন কী হবে? আমার ইম্পরট্যান্ট ফোন করার ছিল।”
“একদিন ফোন না করলে কী হয়?”
“এখন কেমন করে ঠিক করব?”
“সকালে আমাকে দিও আমি ঠিক করিয়ে আনব।”
“কোথা থেকে ঠিক করবি?”
“আমাদের ক্লাসে একটা ছেলে পড়ে নাম সঞ্জয়, সে হচ্ছে মোবাইলের এক্সপার্ট। যে কোনো মোবাইল ঠিক করে ফেলতে পারে। তাকে দিলে সে ঠিক করে দেবে।”
“তোদের ক্লাসের ছেলে? মোবাইল ঠিক করতে পারে?”
মিথ্যা কথা বলা বেশ কঠিন রূপা প্রথমবার টের পেতে শুরু করল।
সরল মুখ করে বলল, “হ্যা–”
”কেমন করে শিখেছে?”
একটা মিথ্যা কথা বললে সেটাকে রক্ষা করার জন্যে আরো দশটা মিথ্যা বলতে হয়। কাজেই রূপাকেও আরো মিথ্যা বলতে হল, “ওর আব্বুর মোবাইলের দোকান আছে, সেখান থেকে শিখেছে।”
তিয়াশা ভুরু কুঁচকে তাকাল তাই রূপাকে আরো মিথ্যা বলতে হল, “সঞ্জয় খুবই ব্রিলিয়ান্ট, বড় হলে নির্ঘাত ইঞ্জিনিয়ার হবে।”
“এমনি এমনি ঠিক করে দেবে?”
“দেবে না? আমাদের ক্লাসের ছেলে আমাদের মোবাইল ফোন ঠিক না করলে কার ফোন ঠিক করবে?”
তিয়াশাকে এবারে একটু চিন্তিত দেখাল, “কিন্তু কাল তো শুক্রবার। স্কুল বন্ধ।”
“আমাদের প্রজেক্টের মিটিং আছে, সঞ্জয়ের সাথে দেখা হবে, তখন ঠিক করে দিতে পারবে।” রূপা পুরো ব্যাপারটা আরো বিশ্বাসযোগ্য করার জন্যে বলল, “তোমার যদি সঞ্জয়কে বিশ্বাস না হয় তুমি মোবাইলের দোকানেও নিতে পার। চৌরাস্তার মোড়ে একটা দোকান আছে। কালকে শুক্রবার মনে হয় বন্ধ।”
“ঠিক আছে আমি তোকেই দেব। দেখি তোর বন্ধু ঠিক করতে পারে কী না।” তিয়াশা মনমরা হয়ে তার ফোনটাকে নানাভাবে ঝাঁকি দিয়ে ঠিক করার চেষ্টা করতে থাকে।
.
সন্ধ্যেবেলা যখন তাদের বাসার সবাই হিন্দি সিরিয়াল দেখতে বসেছে তখন সুলতানা চুপি চুপি রূপার ঘরে এলো। রূপাকে জিজ্ঞেস করল, “কী কর, আফা?”
“আফা না, আপা।”
“একই কথা।” সুলতানা জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করল।
”কী হয়েছে তোমার?”
“কিছু হয়নি।” সুলতানা রূপার বিছানায় হেলান দিয়ে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসল, “মনটা ভালো লাগে না।”
“কেন?”
“কাল রাতে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখলাম।”
“কী স্বপ্ন?”
“মায়েরে সাপে কাটছে আর মা ধড়ফড় ধড়ফড় করছে।”
রূপা হাসার ভান করল, “ধুর! স্বপ্ন দেখে কেউ মন খারাপ করে? স্বপ্ন তো স্বপ্নই। স্বপ্ন তো আর সত্যি না।”
“কিন্তু স্বপ্নটা দেখে ঘুম ভেঙে গেল। মনে হল একেবারে সত্যি। ভোরবেলার স্বপ্ন না কি সত্যি হয়।”
“স্বপ্ন বলে দিলে সেটা আর সত্যি হয় না। তুমি আমাকে বলে দিয়েছ এখন আর সত্যি হবে না।”
“সত্যি বলছ?”
“হ্যাঁ। সত্যি বলছি।”
সুলতানা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “কতদিন মায়েরে দেখি না।”
রূপা বলল, “একবার বাড়ি যাও। মাকে দেখে আস।”
“যেতে তো চাই। কিন্তু খালাম্মা ছুটি দিতে চায় না।”
রূপা কী বলবে বুঝতে পারল না। সুলতানা শেষবার কবে তার বাড়ি গেছে সে মনে করতে পারে না। ঠিক এরকম সময় তার নাকে একটা পোড়া গন্ধ এসে লাগল।”নাক কুঁচকে বলল, কিছু একটা পুড়ছে না কি?”
অমনি সুলতানার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সে লাফ দিয়ে উঠে বলল, “সর্বনাশ! চুলায় ডেকচিটা রেখে আসছি।”
সুলতানা রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেল কিন্তু ততক্ষণে পোড়া গন্ধ রান্নাঘর থেকে বাইরের ঘর পর্যন্ত চলে এসেছে। হিন্দি সিরিয়াল থেকে আম্মুর মনোযোগ রান্নাঘরের পোড়া গন্ধের দিকে চলে গেল। সিরিয়ালের মূল চরিত্র জাসিন্দর আর আনিলার একটা গভীর আবেগময় দৃশ্যের মায়া কাটিয়ে আম্মুও সুলতানার পিছু পিছু রান্নাঘরে গেলেন।
রূপা তার ঘর থেকে প্রথমে আম্মুর চিৎকার তারপর প্রচণ্ড মারধোরের শব্দ শুনতে পেল। মনে হল আম্মু বুঝি সুলতানাকে খুন করে ফেলবেন। প্রথম প্রথম সুলতানার একটা-দুইটা অনুনয়-বিনয় শুনতে পেল কিন্তু আম্মুর হিংস্র চিৎকারে সব চাপা পড়ে গেল। প্রচণ্ড মারধোরের মাঝে সুলতানার কাতর চিৎকার ভেসে আসতে লাগল। রূপা আর সহ্য করতে পারছিল না। যখন প্রায় ছুটে যাচ্ছিল তখন আব্বু গিয়ে আম্মুকে থামালেন। বললেন, “অনেক হয়েছে। এখন ছেড়ে দাও।”