আব্বু আরো একটা কিছু বললেন, রূপা সেটা শোনার জন্যে দাঁড়াল না, দরজা খুলে রাস্তায় নেমে এলো। সে খুব ভালো করে জানে কেউ আদর দিয়ে তার মাথা খায়নি। তাদের তিন ভাই-বোনের মাঝে সে কালো এবং একটু মোটা। তার চেহারাটাও এমন কিছু আহামরি না, চোখে ভারী চশমা থাকার কারণে চোখগুলোকে দেখায় ছোট ছোট। আপু আর মিঠুন দুইজনকে দেখলে মনেই হয়
তারা একই মায়ের পেটের ভাই-বোন। তারা ফরসা আর ছিপছিপে, তাদের দুজনের চেহারাতেই একটা ঝকঝকে ছাপ। ছোট থাকতে রূপা অসংখ্যবার শুনেছে হাসপাতালে আম্মুর আসল বেবির সাথে বদলাবদলি হয়ে সে-অন্য কারো কালো কুৎসিত বাচ্চা, ঘরে চলে এসেছে। যখন ছোট ছিল তখন সেই কথা রূপা প্রায় বিশ্বাসই করে ফেলেছিল। সেই ছোট থেকে সে লক্ষ করেছে আন্ধু-আম্মুর আদর-সোহাগ তার বড় বোন তিয়াশা আর ছোট ভাই মিঠুনের জন্যে। তার জন্যে কখনোই কিছু ছিল না। আব্বু হয়তো ঠিকই বলেছেন সে আসলেই একটা সমস্যা কিন্তু সেই সমস্যার কারণ মোটেই আদর দিয়ে মাথা খাওয়া নয়, অন্য কিছু।
তিন ভাই-বোন রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে। মিঠুন বলল”ইস! তোমার কী মজা ছোট আপু। তুমি নাস্তা না খেলেও আম্মু তোমাকে কিছু বলে না!”
রূপা তার কথায় কোনো উত্তর দিল না। মিঠুন বলল”আমি নাস্তা খেতে না চাইলে আম্মু যা বকা দেয়!”
রূপা এবারেও কোনো কথা বলল না। মিঠুন মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “কী মজা! তোমার কী মজা!”
রূপা আর সহ্য করতে পারল না, মুখ ভেংচে দাঁত খিঁচিয়ে বলল, “হ্যাঁ খুবই মজা সকালবেলা নাস্তা না খেয়ে বকা খেতে খুবই মজা লাগে। পেট ভরে একবার বকা খেলে সারাদিন আর কিছু খেতে হয় না। গাধা কোথাকার।”
মিঠুন একটু অবাক হয়ে রূপার দিকে তাকিয়ে রইল, তার মুখ দেখে মনে হল সে এখনো বুঝতে পারছে না হঠাৎ করে রূপা কেন খেপে উঠল। তিয়াশা ভুরু কুঁচকে রূপার দিকে তাকিয়ে বলল, “দোষ তো তোরই! আম্মু তোর উপর এভাবে রেগেছে কেন? আম্মু রেগেছে তার কারণ, আম্মু যা চায় তার কোনোটাই তুই করিস না!”
“আমি পারি না তাই করি না। আমি তোমার মতো গান গাইতে পারি না, ছবি আঁকতে পারি না, নাচতে পারি না, আবৃত্তি করতে পারি না, পরীক্ষায় ফাস্টও হতে পারি না, আমি কী করব?”
“তুই চেষ্টাও করিস না।”
“আমি কীভাবে চেষ্টা করব? আম্মু চায় আমি এক কোচিং থেকে আরেক কোচিং, এক মাস্টার থেকে আরেক মাস্টারের কাছে দৌড়াতে থাকি! দৌড়িয়ে লাভ কী?”
তিয়াশা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আর তুই কী করিস? আম্মু যেটা চায় না তুই বেছে বেছে সেগুলো করিস!”
রূপা মুখ শক্ত করে বলল, “সেগুলো কী করি?”
“এই মনে কর গল্পের বই পড়া। তুই দিনরাত লুকিয়ে লুকিয়ে গল্পের বই পড়িস।”
“যদি এমনি এমনি পড়তে না দেন তা হলে কী করব?”
“তা হলে পড়বি না। না পড়লে কী হয়?”
রূপা উত্তেজিত হয়ে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। বলে কী হবে? এই বাসায় কাকে সে কী বোঝাবে? এই বাসায় পাঠ্যবই ছাড়া অন্য সব বইকে। বলা হয় আউট বই। বাসায় সবাই বিশ্বাস করে আউট বই পড়লে একজন নষ্ট হয়ে যায়! রূপা অবশ্য জানে না নষ্ট হয়ে যাওয়া মানে কী। মানুষ তো আর দুধের প্যাকেট না যে নষ্ট হয়ে যাবে।
রূপা একটা নিশ্বাস ফেলে হাঁটতে থাকে, কিছু খেয়ে আসেনি, এখনই খিদে লেগে গেছে। খিদে লাগলেই তার মেজাজটা গরম হয়ে থাকে তখন সবার সাথে শুধু ঝগড়া হতে থাকে। আজকে ক্লাশে সে নিশ্চয়ই সবার সাথে ঝগড়া করবে।
মিঠুনকে তার স্কুলে ঢুকিয়ে দিয়ে রূপা আর আপু তাদের স্কুলে এলো। স্কুলের সামনে বেশ কয়েকটা গাড়ি, কয়েক বছর আগেও ছেলেমেয়েরা হেঁটে স্কুলে আসত, খুব বেশি হলে রিকশায়। আজকাল অনেকেই গাড়িতে আসে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে যারা গাড়িতে আসে তাদের চেহারার মাঝে এক ধরনের মিল আছে, মিলটা কোথায়, রূপা এখনো ঠিক ধরতে পারেনি। মনে হয় সেখানে এক ধরনের চিকচিকে ভাব আছে যেটা সাধারণ ছেলেমেয়ের মাঝে নেই।
স্কুলের গেটের কাছাকাছি আসার আগেই আপু রূপা থেকে একটু আলাদা হয়ে গেল। দুই বোন যদিও একই স্কুলে পড়ে কিন্তু স্কুলের ভেতর দুজনকে দেখলে মনে হবে একজন বুঝি আরেকজনকে চিনেই না! এর কারণটাও রূপা জানে না। সে যখন ছোট ছিল তখন স্কুলে এসে তিয়াশার পিছনে ঘুরঘুর করত–তিয়াশা খুব বিরক্ত হত। তিয়াশা দেখতে ভালো, স্কুলের সবকিছুতে থাকে, স্যার-ম্যাডামেরা তিয়াশা বলতে অজ্ঞান আর সে হচ্ছে সবদিক দিয়ে আপু থেকে উল্টো। সেই জন্যে আপু মনে হয় তাকে নিয়ে অন্যদের সামনে একটু লজ্জা পায়, তাই একটু দূরে দূরে থাকে। রূপার ধারণা তার ক্লাশের বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে জানেই না যে রূপার একজন বড় বোন এই স্কুলেই পড়ে!
তিয়াশা দোতলার সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেল। রূপা তার ক্লাশরুমে ঢুকে। আজকে আসতে একটু দেরি হয়েছে তাই জানালার কাছে তার প্রিয় সিটটা বেদখল হয়ে গেছে। সে পিছনে এসে বসল, এই জায়গাটা তার সবচেয়ে অপছন্দের–স্যার-ম্যাডামেরা একেবারে সরাসরি দেখতে পায়, এখানে বসলেই সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন করা হয়। রূপা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, দিনটা যখন খারাপভাবে শুরু হয়েছে সারাটা দিন নিশ্চয়ই খারাপভাবে যাবে।
রূপার সন্দেহটা সত্যি প্রমাণ করার জন্যেই মনে হয় মিম্মি ঠিক তখন তার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। মিম্মি হচ্ছে তার ক্লাশের কুটনি বুড়ি, তার কাজই হচ্ছে একজনের কথা আরেকজনের কাছে লাগানো। সারাক্ষণই সে ফিসফিস করে কারো সম্পর্কে কিছু না কিছু বানিয়ে বানিয়ে বলছে। কাজেই মিম্মি যখন লম্বা লম্বা পা ফেলে তার দিকে এগিয়ে এল তখন রূপা বুঝে গেল অ্যাসেম্বলির ঘণ্টা না পড়া পর্যন্ত তার এখন কুটনামি শুনতে হবে। রূপা একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে সেই জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেল।