রাজুর আম্মু বললেন, “নাক নিয়ে আর ফাইট করতে হবে না। হাত-মুখ ধুয়ে এসে কিছু খা।”
“হ্যাঁ, আম্মু খাব। খিদে লেগেছে।” টেবিলের নানারকম খাবারের দিকে তাকিয়ে বলল, “ময়না খালা তার স্পেশাল চটপটি আর ডালপুরি বানিয়েছে মনে হয়?”
“বানিয়ে লাভ কী? বাচ্চারা তো কেউ কিছু খায়নি।”
রূপা বলল, “খালাম্মা, ওভাবে বলবেন না। আমাদের সঞ্জয় আপনার কথা বিশ্বাস করে আসলেই খেতে শুরু করবে।”
রূপার কথা শুনে সঞ্জয় হি হি করে হাসতে শুরু করে। রূপা বলল, “কী হল? তুই বোকার মতো হাসতে শুরু করেছিস কেন?”
সঞ্জয় হাসতে হাসতে একবার হেঁচকি তুলল, রাজুর বোন মিথিলা একটু ভয় পেয়ে বলল, “কী হল? কী হল তোমার?”
রূপা বলল, “কিছু হয়নি। সঞ্জয়ের মাথার ক্রু ঢিলা। যখন-তখন এইরকম বোকার মতো হাসতে থাকে।”
সঞ্জয় হি হি করে হাসতে হাসতে কোনোভাবে বলল, “আমি মোটেও বোকার মতো হাসতে থাকি না।”
রাজুর বড় বোন মিথিলা হাত-মুখ ধুয়ে তাদের পাশে এসে বসে। একটা বাটিতে খানিকটা চটপটি নিয়ে খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল, “তোমাদের কাজ হল?”
মিম্মি বলল, “সব এখনো শেষ হয়নি।”
“তোমাদের কী কাজ সেটা একটু শুনি।”
মিম্মি মুখ গম্ভীর করে বলল, “আমরা সবাই সায়েন্স প্রজেক্ট করব তো, সেই জন্যে আলাপ-আলোচনা করছি।”
মিথিলা চোখ মটকে বলল, “তোমাদের আলোচনা কী ফলপ্রসূ হয়েছে?”
মিম্মি ঠাট্টাটা ঠিক ধরতে পারল না, বলল, “জি। ফলপ্রসূ হয়েছে।”
মিথিলা হি হি করে হাসতে হাসতে বলল, “গুড! আমাদের রোবট ভাই রাজু দ্বিপাক্ষিক-ত্রিপাক্ষিক আলোচনা করতে শিখেছে সেটা খারাপ কী?”
রাজু বলল, “আপু, আমাকে যদি রোবট বল, তা হলে তুমি কী? তুমি তো রোবট থেকেও কাঠখোট্টা!”
মিথিলা হঠাৎ করে মুখটা গম্ভীর করে ফেলল, বলল, “সেটা ঠিকই বলেছিস। ডাক্তারি পড়তে পড়তে কাঠখোট্টা হয়ে যাচ্ছি। প্রথম প্রথম যখন দেখতাম কোনো একজন রোগী মারা গেছে কয়েক রাত ঘুমাতে পারতাম না। এখন দেখি সহজভাবে নেই। আজকে যেরকম–”
রূপা জিজ্ঞেস করল, “আজকে কী হয়েছে?”
“একজন অ্যাকসিডেন্ট করে এসেছে, বাইরে থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই তার কিছু হয়েছে। রেসিডেন্ট ডাক্তার পরীক্ষা করে এসে বললেন, বাঁচবে না। আগে হলে শুনে আধাপাগল হয়ে যেতাম, আজকে দেখি মেনে নিলাম! কী আশ্চর্য!”
রাজু হতাশভাবে মাথা নাড়ল, “আপু তুমি আসলেই মেশিন হয়ে যাচ্ছ।”
“ছোট বাচ্চাদের কিছু দেখলে অবশ্যি এখনো সহ্য করতে পারি না। হাসপাতালে একটা পেশেন্ট এসেছে বয়স তেরো-চৌদ্দ থেকে বেশি হবে না। ড্রাগ ওভারডোজ।”
রাজু চমকে উঠল, “কী ওভারডোজ?”
“ড্রাগ। নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হতে চায় না স্কুলের বাচ্চারাও ড্রাগস নিচ্ছে। কী সর্বনাশ!”
রূপা আর রাজু একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। মিম্মি জিজ্ঞেস করল, “স্কুলের বাচ্চারা?”
“হুঁশ। তোমাদের বয়সী বাচ্চারা। অবিশ্বাস্য।”
মিম্মি জিজ্ঞেস করল, “ড্রাগ খেলে কী হয়?”
“অনেক কিছু হয়। কোন ড্রাগ নিচ্ছে তার উপর নির্ভর করে কী ভয়ংকর অবস্থা হতে পারে। মাসখানেক আগে একজনকে এনেছে–সে ড্রাগ খেত, জোর করে তাকে ড্রাগ খাওয়া বন্ধ করেছে তাই মানুষটা ছটফট করতে করতে মরে গেল।”
“মরে গেল? মানে সত্যি মরে গেল?”
“হ্যাঁ, সত্যি মরে গেল।”
মিমি জিজ্ঞেস করল, “ড্রাগ বন্ধ করলে মানুষ মরে যায়?”
“অনেক ড্রাগ আছে যেটা খেলে শরীর অভ্যস্ত হয়ে যায় তখন যদি হঠাৎ করে বন্ধ করে দেওয়া হয় তখন শরীর বিদ্রোহ করে, এটাকে বলে ড্রাগ উইথড্রয়াল সিনড্রোম, ভয়ংকর রিঅ্যাকশন হয়, মানুষ চোখের পলকে মরে যায়।”
“কী সর্বনাশ!”
মিথিলা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, কী সর্বনাশ। এই ড্রাগগুলো যে কী ভয়ংকর। কেউ চিন্তাও করতে পারবে না। না বুঝে এক-দুইবার খেয়ে এডিক্ট হয়ে যায়। তখন আর কোনো মুক্তি নাই। ফ্যামিলির পর ফ্যামিলির সর্বনাশ হয়ে যায়। শেষ হয়ে যায়।”
রূপা জিজ্ঞেস করল, “ড্রাগ খেলে কী হয়?”
“সেটা নির্ভর করে ড্রাগের উপর। এখানে যেটা বেশি খায় সেটার লোকাল নাম বুলবুলি, খেলে হার্টবিট বেড়ে যায়, ব্লাড প্রেশার বেড়ে যায়, চোখের পিউপিল ডায়লেট করে, ঘামতে থাকে, টেম্পারেচার বেড়ে যায়, বক বক করে কথা বলতে থাকে, মনে হতে থাকে খুব আনন্দ হচ্ছে। যদি ভোজ বেশি খায় তা হলে হেলুসিনেট করে, আজব আজব জিনিস দেখে, জেগে থাকে দুঃস্বপ্ন দেখার মতো—” মিথিলা হাত নেড়ে থেমে যায়।
“তারপর কী হয়?”
“শুকিয়ে কাঠি হয়ে যায়। খিদে থাকে না, রাতে ঘুমাতে পারে না–যদিবা ঘুমায় ভয়ংকর ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠে। সারারাত বসে থাকে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, কাউকে বিশ্বাস করে না। ড্রাগসের নেশা ভয়ংকর নেশা–তার জন্যে টাকার দরকার। নিজের টাকা না থাকলে টাকা চুরি করে। ছিনতাই করে, ডাকাতি করে। নিজের ফ্যামিলির মানুষকে মারধর করে। দেখবে পুরোপুরি সুস্থ সমর্থ ভালো একজন ছেলে বা মেয়ে শুধুমাত্র ফূর্তি করার জন্যে একবার একটু ড্রাগ খেয়ে পুরোপুরি এডিক্ট হয়ে গেছে। কিছু বোঝার আগে পুরোপুরি ভালো একটা ছেলে একেবারে হার্ডকোর ক্রিমিনাল হয়ে গেছে।”
রাজু জিজ্ঞেস করল, “আপু কেউ যদি ড্রাগ এডিক্ট হয়ে যায় তা হলে তাকে আর ভালো করা যায় না?”
“অনেক কষ্ট হয়। ড্রাগ রিহেবিটেলিশান সেন্টারে নিতে হয়, ডাক্তারদের চোখে চোখে রাখতে হয়–চিকিৎসা করতে হয়। ফ্যামিলি আর বন্ধু-বান্ধব সবাই মিলে যদি সাহায্য করে পাশে থাকে, সাপোর্ট দেয় তা হলে হয়তো বের হয়ে আসতে পারে।”