রাশা অবাক হয়ে তার নানির দিকে তাকাল, বলল, “কী বললে?”
“বলেছি যে আমি তোর জন্যে অপেক্ষা করছি। আমি জানতাম তুই আজকে আসবি।”
“কেমন করে জানতে?”
“আমি তো পাগল মানুষ, মাথার ঠিক নাই। উল্টাপাল্টা জিনিস মাথায় আসে। আজকে সকালবেলা মাথায় এসেছে তুই আসবি। সেই জন্যে ট্রাঙ্ক থেকে এই শাড়িটা বের করে পরেছি।”
রাশা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তার এই মাথা খারাপ নানির দিকে তাকিয়ে রইল। নানি মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, “তুই আমার কথা বিশ্বাস করলি না? ঠিক আছে তোর হাতটা খোল—”
রাশা তার হাতটা খুলল। নানি তার মুঠি খুলে কিছু একটা বের করে তার হাতে দিয়ে তার মুঠি বন্ধ করে বললেন, “এই যে–তোকে দেয়ার জন্যে এইটা আমি হাতে নিয়ে বসে আছি। এখন তোকে দিলাম।”
“এইটা কী?”
“আমার মা আমাকে দিয়েছিল। আমার মা পেয়েছিল তার মায়ের কাছে। তার মা পেয়েছিল তার মায়ের কাছ থেকে।”
রাশা আবার কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল, “এইটা কী?”
“একটা মাদুলি।”
“কী হয় এইটা দিয়ে?”
“কাছে আয় তোকে কানাকানি বলি।” রাশা তার মাথাটা এগিয়ে দেয়, তার নানি রাশার থুতনিটা ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “পাক সাফ পবিত্র হয়ে এই মাদুলিটা হাতে নিয়ে তুই যেটা চাইবি সেটাই পাবি।”
“সেটাই পাব?”
“হ্যাঁ। কিন্তু সবকিছু চাইতে হয় না। যেটা পাওয়া যায় না সেটা চাইতে হয় না। সেইটা চাইলে মাদুলির গুণ নষ্ট হয়ে যায়। আমার হাতে গুণ নষ্ট হয়ে গেছে। আমি চাইলে আর পাই না। তুই পাবি।”
“তুমি কিভাবে গুণ নষ্ট করেছ?”
“নীলুর বাপের জানটা ফেরত চেয়েছিলাম সেই জন্যে গুণ নষ্ট হয়েছে। মওত হয়ে গেলে জান ফেরত চাইতে হয় না–”
আম্মু বললেন, “মা, তুমি এখন এইসব কথা রাশাকে কেন বলছ?”
নানি বললেন, “ইচ্ছে হয়েছে বলেছি। তাতে তোর কী? তুই তোর মেয়েকে আমার কাছে ফেলে যাচ্ছিস কেন? আমি কি বলেছিলাম তোকে ফেলে যেতে?”
“না, মানে, রাশা ছোট মানুষ, তোমার এইসব কথা যদি বিশ্বাস করে ফেলে—”
“বিশ্বাস করবে না কেন? আমি কি মিথ্যা কথা বলেছি?”
আম্মু চুপ করে গেলেন। নানি রাশার মাথাটা আবার নিজের কাছে টেনে এনে ফিসফিস করে বললেন, “আমি এই মাদুলিটা তোর মাকে দিই নাই। তোর জন্য রেখেছি।”
“কেন?”
আম্মু যেন শুনতে না পান সেভাবে গলা নামিয়ে বললেন, “তোর আম্মু এইটার যোগ্য না। এটা রাখতে হলে যোগ্যতা থাকতে হয়।”
“আমার যোগ্যতা আছে?”
“আছে।”
রাশা তার নানির চোখের দিকে তাকাল তখন নানি একটু হাসলেন, তার কঠিন মুখটা হঠাৎ কেমন যেন নরম হয়ে উঠল।
রাশা শক্ত করে মাদুলিটা ধরে চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলল, “খোদা তুমি আমাকে বাঁচাও, প্লিজ খোদা–আমি খুব বিপদে আছি!”
.
উঠানের একপাশে আম্মু রাশার হাত ধরে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেললেন, বললেন, “রাশা মা তুই আমাকে মাফ করে দিস।”
রাশা কোনো কথা বলল না। আম্মু বললেন, “মা-ই মনে হয় ঠিক বলেছেন। তোর গলাটা কেটে নদীতে ভাসিয়ে দিলেই মনে হয় বেশি ভালো
রাশা এবারেও কোনো কথা বলল না। আম্মু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কঁদিতে বললেন, “আমি একটু গুছিয়ে নিয়ে তোকে নিতে আসব। খোদার কসম।”
রাশা চোখের পানি আটকে মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক আছে।”
আম্মু তখন তার ব্যাগ থেকে একটা মোটা খাম বের করে রাশার হাতে দিয়ে বললেন, “নে। এটা রাখ।”
“এটা কী?”
“কিছু টাকা। বেশি দিতে পারি নাই। দশ হাজার টাকা আছে। তোর কাছে রাখ। লুকিয়ে রাখিস, কাউকে জানতে দিস না।”
রাশা বলল, “আমি টাকা দিয়ে কী করব?”
“তোর লাগবে! সাথে রাখ। নে মা।”
রাশা প্যাকেটটা হাতে নিল। আম্মু তখন চোখ মুছে বললেন, “আর শোন।
“তোর নানির উল্টাপাল্টা কথা বিশ্বাস করিস না। মাথা খারাপ মানুষ, অনেক উল্টাপাল্টা কথা বলে।”
রাশা কোনো কথা বলল না। আম্মু বললেন, “সেভেন্টি ওয়ানে যখন বাবাকে মেরে ফেলল তখন থেকে আস্তে আস্তে মাথা খারাপ হয়ে গেল।”
রাশা বলল, “ও।”
“মাথা খারাপ মানুষ তো, একটু মানিয়ে চলিস।”
“চলব।”
আম্মু তখন রাশাকে জড়িয়ে ধরলেন, খানিকক্ষণ ধরে রাখলেন, তারপর ছেড়ে দিয়ে মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি যাই?”
“যাও।”
“কিছু একটা বল।”
“কী বলব?”
“কিছু বলবি না তোর মাকে?”
“আমার জন্য চিন্তা করো না। আমার ব্যবস্থা আমি করে নেব আম্মু।”
রাশা চাইছিল না তবুও তার মুখে কেমন যেন একটা হাসি ফুটে উঠল। সেই হাসিতে কোনো আনন্দ নেই, সেই হাসিতে গভীর বিষাদ। আম্মু অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর ঘুরে হেঁটে হেঁটে চলে যেতে লাগলেন।
রাশা টিনের ঘরের বারান্দায় বসে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। মুরগি তার ছানাগুলোকে নিয়ে এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছানাগুলো তার মায়ের আশেপাশে থাকে, ছানাগুলো জানে তাদের মা সবসময় তাদের দেখেশুনে রাখবে, বিপদ থেকে রক্ষা করবে। রাশা তাকিয়ে দেখল, তার মা তাকে একটা গহীন গ্রামে তার মাথা খারাপ নানির কাছে ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
সে দুই হাতে তার মুখ ঢেকে ফেলে। বিড়বিড় করে বলল, “কাঁদব না। আমি কাঁদব না। কিছুতেই কাঁদব না।”
তারপরেও সে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।
০৩. মাথা খারাপ নানি
রাশা বারান্দায় পা তুলে বসে আছে, তাকে ঘিরে ছোট একটা ভিড়! বেশ কিছু পেট মোটা শিশু একধরনের কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের গায়ে কোনো কাপড় নেই, পোশাক বলতে কোমরে একটা কালো সুতো, সেখান থেকে নানা আকারের তাবিজ ঝুলছে। কিছু কম বয়সী মেয়েও আছে, তাদের এক-দুইজন শাড়ি পরে আছে, তাই তাদের দেখে রীতিমতো বড় মানুষের মতো মনে হচ্ছে। কয়েকজন রুগ্ণ মহিলা, তাদের কোলে ন্যাঁদা ন্যাঁদা বাচ্চা, বাচ্চাদের গলায় বড় বড় তাবিজ।