ট্রলারের উপর আহাদ আলী দুজনকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, চারিদিকে তারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, কোথাও রাশার চিহ্ন নাই। আহাদ আলী মুখ খিঁচিয়ে বলল, “সংয়ের মতো দাঁড়িয়ে কী দেখছিস? পানিতে নাম– খুঁজে বের কর মেয়েটাকে।”
“কিন্তু গেল কই?”
“আমাকে জিজ্ঞেস করবি না গেল কই? খুঁজে বের কর।”
মানুষ দুজন তখন পানিতে নামল, কেমন করে খুঁজবে বুঝতে পারছিল না, তবু ডুবে ডুবে এদিক-সেদিক গেল, বৃথাই খোঁজার চেষ্টা করল। ঘণ্টাখানেক খুঁজে যখন হাল ছেড়ে দিয়ে নদী থেকে উঠে এসেছে তখন আহাদ আলী লক্ষ করল দূরে পুলিশের একটা স্পিডবোট দেখা যাচ্ছে। সে একটা নিশ্বাস ফেলল, সবকিছু কেমন যেন গোলমাল হয়ে গেছে। মেয়েটা বেঁচে থাকলে মহাসমস্যা। ডুবে যদি মরে গিয়ে থাকে, আর এক-দুই দিন পর যদি লাশ ভেসে ওঠে সেটাও সমস্যা। কথা ছিল মেয়েটাকে বিলের পানিতে ফেলে আসবে যেন কেউ সন্দেহ করতে না পারে।
স্পিডবোটে পুলিশের সাথে সালাম নানা ছিলেন, মতি আর জিতুও ছিল। স্পিডবোট থেকে নেমে পুলিশ যখন চারিদিকে খুঁজতে থাকে তখন মতি আর জিতু নদীর তীরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ডাকতে থাকল, “রাশা আপু! রাশা আপু! তুমি কোথায়। কেউ তাদের ডাকের উত্তর দিল না। দুজন তখন নদীর তীর ধরে ছুটতে থাকে আর চিৎকার করে ডাকতে থাকে, “রাশা আপু! রা-শা-আ-পু!”
রাশা সারা শরীর পানিতে ডুবিয়ে কচুরিপানার মাঝে তার মাথাটা একটুখানি বের করে শুয়েছিল, মতি আর জিতুর গলার স্বর শুনে সে সোজা হয়ে বসল। গলার স্বরটা যখন আরো একটু স্পষ্ট হলো তখন সে পানি থেকে বের হয়ে এলো, তার সমস্ত শরীরে কাদা, পানিতে ডুবে থেকে তার চোখ লাল, মুখ রক্তশূন্য। মতি আর জিতু রাশাকে ডাকতে ডাকতে ছুটে যেতে যেতে হঠাৎ করে রাশাকে দেখতে পায়, তখন তারা চিৎকার করে নদীর তীরে নেমে এসে তাকে জাপটে ধরে ফেলল! মতি রাশাকে শক্ত করে ধরে বলল, “রাশা আপু! রাশা আপু তুমি বেঁচে আছ? তুমি বেঁচে আছ রাশা আপু?”
রাশা খকখক করে একবার কাশল, তারপর বলল, “হ্যাঁ মতি। খোদা আমাকে বঁচিয়ে দিয়েছে।”
“আর তোমাকে কেউ মারতে পারবে না!” মতি রাশাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “কেউ পারবে না। কেউ পারবে না।” তারপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। মতি এর আগে কখনো কাঁদেনি কেমন করে কাঁদতে হয় সে জানে না।
.
আহাদ আলীর উঠানে একটা চেয়ারে আহাদ আলী কঠিন মুখে বসে আছে। তার সামনে একজন পুলিশ অফিসার, আহাদ আলী মিছিমিছি তাকে সন্দেহ করার জন্যে সেই পুলিশ অফিসারকে ধমকাধমকি করছিল। ঠিক এরকম সময় মতি আর জিতুর হাত ধরে রাশা সেখানে হাজির হলো। সারা শরীরে কাদা, তাকে ঠিক চেনা যাচ্ছে না, তারপরেও আহাদ আলী তাকে চিনতে পারল এবং ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। তার দুই পাশে তার দুজন সাগরেদ দাঁড়িয়ে ছিল। তারা হঠাৎ করে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করল, কিন্তু বেশিদূর যেতে পারল না, পুলিশের লোকজন দৌড়ে তাদের ধরে ফেলল।
সালাম নানা ক্রাচে ভর দিয়ে রাশার কাছে ছুটে গেলেন, তাকে ধরে বললেন, “রাশা! তুমি ঠিক আছ?”
রাশা মাথা নেড়ে বলল, “না, নানা। নাকে-মুখে পানি ঢুকে গেছে।” সে খুকখুক করে কেশে বলল, “নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে মরে যাব।”
“না, তুমি মরবে না। তুমি এখন পর্যন্ত যখন বেঁচে আছ, আমরা তোমাকে মরতে দিব না?”
হঠাৎ করে রাশার মনে হলো তার পায়ে কোনো জোর নেই, সে পড়ে যাচ্ছিল, সালাম নানা তখন তাকে ধরে ফেললেন। রাশা ফিসফিস করে বলল, “যদি আমি মরে যাই, আপনাকে একটা জিনিস বলে রাখি!” রাশা আঙুল দিয়ে আহাদ আলীকে দেখিয়ে বলল, “এই যে রাজাকারটাকে দেখছেন–সে আমাকে বলেছে, সে আমার নানাকে মেরেছে! মেরে তার ডেডবডি একটা মাদার গাছের নিচে পুঁতে রেখেছে।”
রাশা আবার খকখক করে কাশল, তার কাশির সাথে ময়লা ঘোলা পানি বের হয়ে আসে। হঠাৎ করে তার মাথা ঘুরে আসে, সে সালাম নানার কোলে অচেতন হয়ে পড়ল।
সালাম নানা চিৎকার করে বললেন, “স্পিডবোট! কুইক। মেয়েটাকে এক্ষুণি হাসপাতালে নিতে হবে।”
১৫. শেষ কথা
অনেক দিন পরের কথা।
শীতের রাতে আকাশে একটা চাঁদ উঠেছে, কুয়াশায় সেই চাঁদকে কেমন যেন অস্পষ্ট দেখায়। চারিদিকে জোছনার ঘোলাটে আলো। কান পেতে থাকলে শোনা যায় গাছের পাতা থেকে টুপটুপ শব্দ করে শিশির পড়ছে মাটিতে।
এর মাঝে নানি একটা হ্যারিকেন নিয়ে বের হচ্ছেন, রাশা জিজ্ঞেস করল, “নানি, তুমি কই যাও?”
নানি লাজুক মুখে একটু হাসলেন, বললেন, “আমি আর কোথায় যাব? তোর নানার সাথে একটু কথা বলে আসি!”
রাশা বলল, “আমি আসি তোমার সাথে?”
“আসবি? আয় তাহলে! কবরস্থানে রাতবিরেতে ভয় পাবি না তো?”
“না, নানি। তুমি ভয় না পেলে আমিও ভয় পাই না।”
“হ্যাঁ, ভয় কিসের? তোর নানা আমাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে না?”
রাশা চোখের কোনা দিয়ে নানির মুখের দিকে তাকাল। নানি এমনভাবে কথা বলেন যে শুনে মনে হয় সত্যিই বুঝি নানা কবরের মাঝে শুয়ে নানির জন্যে অপেক্ষা করে থাকেন।
আহাদ আলীর বাড়ির পিছনে একটা বড় মাদার গাছের নিচে খুঁড়ে সত্যিই নানার দেহাবশেষটা পাওয়া গিয়েছিল। জায়গাটা আহাদ আলীই দেখিয়ে দিয়েছিল, তার হাতে হাতকড়া লাগিয়ে সেখানে রাখা হয়েছিল। যেদিন খুঁড়ে বের করা হয় সেদিন রাশাও ছিল সেখানে, সালাম নানা কিন্তু তাকে যেতে দেননি। তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, “তুমি কাছে এসো না সোনা?”