আহাদ আলী বেঞ্চের এক মাথায় বসে বলল, “সেইটা তুই এখনো বুঝিসনি? আমি তোরে টেলিভিশনে কথা বলতে দেখেছি, তুই কী বলেছিস আমি শুনেছি!” আহাদ আলী হিংস্র গলায় বলল, “আমার নাম উচ্চারণ করতে তোর ঘেন্না লাগে? আমি তোকে দেখাব ঘেন্না কেমন করে লাগতে হয়। শুধু তুই না তোর চৌদ্দ গুষ্টি দেখবে কেমন করে ঘেন্না করতে হয়।” আহাদ আলী হঠাৎ জঘন্য ভাষায় গালাগাল করতে থাকে। একজন বয়স্ক মানুষের মুখ থেকে যে এরকম অশ্লীল শব্দ বের হতে পারে নিজের কানে না শুনলে সে বিশ্বাস করতে পারত না।
রাশা ভয় পাবার ভঙ্গি করে। পা দুটো গুটিয়ে আনে, দাঁত দিয়ে নখ কাটে তারপর প্লাস্টিকের বোতলের নিচের অংশটা টিপে ভঁজ করে সেটা নাড়াচাড়া করতে থাকে, নার্ভাস ভঙ্গিতে দাঁত দিয়ে কামড়ানোর চেষ্টা করে এবং শেষ পর্যন্ত প্লাস্টিকের একটা অংশ দাঁত দিয়ে কেটে ফেলে। রাশার বুকের ভেতর থেকে স্বস্তির নিশ্বাস বের হয়ে আসে। সে বেঁচে থাকতে পারবে কি পারবে না সেটা নির্ভর করছে এই প্লাস্টিকের বোতলটার ওপর। এর তলাটা আলাদা করতে পারবে কি পারবে না তার ওপর। প্লাস্টিকের বোতলে যেখানে একটু কেটেছে সেখানে আঙুলটা ঢুকিয়ে টানতে থাকে। প্লাস্টিকের ধারালো কাটা অংশে তার আঙুল কেটে যেতে চায় কিন্তু সে থামল না–টেনে আলগা করতেই লাগল।
আহাদ আলী একসময় থামল, রাশা তখন আবার জিজ্ঞেস করল, “আমাকে এখন কী করবেন?”
আহাদ আলী উত্তর দেবার আগেই একজন হা হা করে হেসে উঠল, “ছেমড়ি? তুই এখনো বুঝিস নাই তোরে কী করব? তুই কী ভেবেছিস তোরে দুলহা বানিয়ে কারো সাথে শাদি দিব? না। তোরে পানিতে ডুবিয়ে মারব! বুঝেছিস?”
রাশা মাথা নেড়ে বোঝাল, সে বুঝেছে। হাত দিয়ে টেনে প্লাস্টিকের বেতিলের তলাটা সে প্রায় আলগা করে ফেলেছে, এখন সে তার শেষ অংশটুকুর জন্যে প্রস্তুত হয়েছে। মানুষ দুটো যখন একটু অসতর্ক থাকবে ঠিক তক্ষুণি তাকে লাফ দিয়ে উঠে একলাফে জানালা থেকে পানিতে লাফিয়ে পড়তে হবে। একটা মাত্র সুযোগ পাবে সে। তার জীবনের শেষ সুযোগ। এই সুযোগটা যদি সে নিতে না পারে কেউ আর তাকে রক্ষা করতে পারবে না!
রাশা বিড়বিড় করে মনে মনে বলল, “হে খোদা! তুমি আমাকে রক্ষা করো খোদা। আমি তোমার কাছে আর কোনোদিন কিছু চাইব না! শুধু তুমি আমাকে একটা সাহায্য করো–শুধু একটুখানি।”
রাশা মানুষ দুটির দিকে তাকিয়েছিল, একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলছে, একটু অসতর্ক, রাশ ঠিক সেই মুহূর্তটাকে বেছে নিল। প্লাস্টিকের বোতলটা ধরে সে উঠে দাঁড়ায় তারপর বিড়ালের মতো লাফিয়ে জানালার ভেতর দিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মানুষগুলো ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়, এক মুহূর্ত লাগে তাদের বুঝতে কী হচ্ছে। শেষ মুহূর্তে দুজন ছুটে এসে তাকে ধরার চেষ্টা করল, তার পা প্রায় ধরেই ফেলেছিল কিন্তু হ্যাঁচকা টানে শেষ মুহূর্তে রাশা নিজেকে মুক্ত করে নেয়।
রাশা হাত-পা নেড়ে তীরের দিকে সাঁতরাতে থাকে–মাথা তুলে একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে সে ডুবসাঁতার দেয়ার জন্যে ডুবে গেল।
আহাদ আলী অশালীন একটা গালি দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। মানুষ দুজন একজন আরেকজনের দিকে তাকিয় বলল, “এই ছেমড়ি দেখি যন্ত্রণার একশেষ!”
আহাদ আলী বলল, “দাঁড়িয়ে আছিস কেন? মেয়েটাকে ধর।”
মানুষটা বলল, “হুজুর আমার আর ধরা লাগবে না। এই পানিতে যাবে কোথায়? ভেসে উঠুক আমি ধরছি।”
অন্য মানুষটা বলল, “এই মেয়ে পানির মাঝে আমার থেকে জোরে সাঁতার দিবে? খালি মাথাটা বের করুক।”
রাশা যেদিকে সঁতরে গেছে সবাই সেদিকে তাকিয়ে থাকে, নিশ্বাস নেবার জন্যে তাকে মাথা বের করতে হবে তখনই তারা তাকে ধরার জন্যে অন্য দুজন পানিতে নামবে।
মানুষ দুজন শার্ট খুলে খালি গা হয়ে নিল। লুঙ্গিটাকে মালকোচা মেরে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে দুজনেই তৈরি। কোনদিকে যাবে সেটা ঠিক করার জন্যে তারা পানির দিকে তাকিয়ে আছে। নিশ্বাস নেবার জন্যে রাশা মাথা বের করা মাত্রই তারা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
রাশা নিশ্বাস নেবার জন্যে মাথা বের করল না। মানুষগুলো অবাক হয়ে দেখল এক মিনিট দুই মিনিট করে পাঁচ মিনিট পার হয়ে গেল কিন্তু রাশা পানি থেকে মাথা বের করল না। মানুষগুলো একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল, বলল, “কই গেছে মেয়েটা?”
আহাদ আলী বলল, “ডুবে গেছে নাকি?”
“ডোবার কথা না। যেই মানুষ সাঁতার জানে সে ডুবে না।”
আহাদ আলী খেঁকিয়ে উঠল, “তাহলে গেছে কই?”
“সেইটাই তো তাজ্জব। মানুষ আর যেটাই করুক নিশ্বাস না নিয়ে তো বেঁচে থাকতে পারে না। এই ছেমড়ির তো নিশ্বাস নেবার জন্য মাথা বের করতে হবে।”
তারা পানির দিকে ইতিউতি করে তাকায়, চারিদিকে পানি, কোথাও রাশা নেই। সে একবারও নিশ্বাস নেবার জন্যে মাথা বের করেনি। মেয়েটা ম্যাজিকের মতো অদৃশ্য হয়ে গেছে। হঠাৎ করে মানুষগুলো একধরনের অস্বস্তি বোধ করতে থাকে।
.
রাশা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রথমে সোজা তীরের দিকে এগিয়ে গেল, খানিকদূর এগিয়ে সে মাথা উঁচু করে বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে আবার ডুব দেয়। এবারে সে ডানদিকে ঘুরে গেল, নদীর স্রোতটা যেদিকে। ডুব সাঁতার দিয়ে সরে যেতে থাকে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, যতদূর সম্ভব। যখন তার নিশ্বাস শেষ হয়ে আসে তখন প্লাস্টিকের বোতলটা মুখে লাগিয়ে চিৎ হয়ে একটু উপরে উঠে আসে। বোতলটার উপরের অংশটা পানির একটু উপর ওঠা মাত্রই সে পানিটুকু টেনে সরিয়ে খালি করে নেয়। বাতাসের জন্যে তার বুকটা তখন হাহাকার করছে কিন্তু তবুও সে তাড়াহুড়া করল না। পুরো বোতলটা খালি হবার পর সে বাতাস টেনে নেয়, বুক ভরে একবার নিশ্বাস নেয়। তারপর আবার সে ডুবে গেল, ভুবসাঁতার দিয়ে সে আবার সরে যেতে থাকে-যতদূর সম্ভব। যখন আবার তার নিশ্বাস শেষ হয়ে এলো আবার সে বুক ভরে নিশ্বাস নেয়। তারপর সে ডুবসাঁতার দিয়ে আবার সরে যেতে থাকে।