রাশা শুনতে পেল মোটা একজন বলল, “নাহ, মনে হয় দেরি করা ঠিক হবে না। খবর পেয়েছি এই ছেমড়ির পরিচিত লোকজন সন্দেহ করছে তাকে এইখানে আনা হয়েছে। পুলিশ-টুলিশ এসে যদি ছেমড়িকে এখানে পেয়ে যায় ঝামেলা হবে!”
“পুলিশে আমাদের লোক আছে না হুজুর?”
“আছে বলেই তো খবরটা পেয়েছি। তাড়াতাড়ি কাজ সেরে ফেলতে হবে।”
“ঠিক আছে।”
“কই? ছেমড়ি কই?”
“এই যে হুজুর এদিকে। ট্রলারের বেঞ্চে বেঁধে রেখেছি।” রাশা দেখল একজন বুড়ো মানুষ ট্রলারের ভেতরে ঢুকেছে। তার লম্বা পাকা দাড়ি, মাথায় গোল টুপি। একটা পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরে আছে। এই বুড়ো মানুষটা নিশ্চয়ই আহাদ আলী রাজাকার। রাশা মানুষটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
দাড়িওয়ালা মানুষটা এগিয়ে এসে রাশার দিকে ঝুঁকে তাকাল, বলল, “এইটাই সেই ছেমড়ি?”
“জি হুজুর।”
“মুখের গামছাটা খোল দেখি, চেহারাটা দেখি।”
একজন এসে মুখের বাঁধন খুলে দিল, রাশা অনেকক্ষণ পর বুক ভরে নিশ্বাস নিল, তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। সে একবার ঢোক গিলে বলল, “আমি একটু পানি খাব।”
আহাদ আলী বলল, “কী বললি?”
“আমি বলেছি, আমি একটু পানি খাব।”
আহাদ আলী হঠাৎ দুলে দুলে হাসতে শুরু করে। লোক দুজন একটু অবাক হয়ে আহাদ আলীর দিকে তাকায়, সে ঠিক কী জন্য হাসছে তারা বুঝতে পারছে না। আহাদ আলী বলল, “এর নানাও আমারে বলেছিল, আমি একটু পানি খাব। এতদিন পর তার নাতনিও আমাকে বলে, আমি একটু পানি খাব।”
রাশা মানুষটার দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “আপনি আমার নানাকে মেরেছেন?”
ঘরের ভেতরে হঠাৎ সবাই চুপ করে গেল। রাশা আবার জিজ্ঞেস করল, “মেরেছেন?”
আহাদ আলীর মুখটা হঠাৎ কেমন জানি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে, সে হিংস্র গলায় বলে, “হ্যাঁ মেরেছি। মেরে ঐ মাদার গাছের তলায় পুঁতেছি। তো কী হয়েছে? তুই কী করবি?”
রাশার বুকটা হঠাৎ ধক করে উঠে। এই মানুষটা তার সামনে অবলীলায় স্বীকার করল যে সে নানাকে মেরেছে–এই কথাটা তাকে জানাতে মানুষটা আর ভয় পাচ্ছে না। তার একটাই অর্থ, মানুষগুলো আসলে এখন তাকেও মেরে ফেলবে। কাজেই এখন তাকে যা ইচ্ছে তাই বলা যায়। এই কথাগুলো বাইরে কোথাও প্রকাশ হবে না। রাশা হঠাৎ ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠল। সে জিব দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, “আমি একটু পানি খাব।”
আহাদ আলীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা মুখ খিঁচিয়ে বলল, “তোরে পানি খাওয়ানোর জন্যেই আনছি! এই যে গাঙ দেখছিস, একটু পরে তুই এই পানি খাবি। মুখ দিয়ে খাবি, নাক দিয়ে খাবি! পানি খেয়ে তুই গাঙের নিচে শুয়ে থাকবি।”
অন্য লোকটা বলল, “তোর নানা ছিল ইন্ডিয়ার দালাল! গাদ্দার। তার সাথে তোর দেখা হবে। তুই আর তোর নানা জয়বাংলা জয়বাংলা করে লেফট-রাইট করবি। বুঝেছিস?”
রাশা বলল, “আমি একটু পানি খাব।”
লোকটা মুখ খিঁচিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, আহাদ আলী বলল, “দে! একটু পানি দে। শেষ সময়ে একটু শখ করেছে, খেতে দে।”
“হুজুর, গাঙে এত পানি আছে, খেয়ে শেষ করতে পারবে না।”
“থাক থাক। নৌকায় বোতলে পানি আছে, পানি খেতে দে।”
লোকটা একটু বিরক্ত হয়েই নৌকা থেকে পানির বোতলটা আনতে গেল। একটু পর লোকটা একটা প্লাস্টিকের বোতল নিয়ে এলো, তার নিচে অল্প একটু পানি। সে পানির বোতলটী খুবই তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে রাশার দিকে ছুঁড়ে দেয়। রাশা বলল, “আমার হাতটা খুলে দিতে হবে।”
মানুষটা একেবারে মারের ভঙ্গিতে এগিয়ে গিয়ে বলল, “আর কী কী করতে হবে?”
রাশা বলল, “আমার হাত খুলে না দিলে পানি খাব কেমন করে?”
আহাদ আলী বলল, “খুলে দে হাত।”
“যদি অন্য কিছু করে?”
“তোরা দুইজন দামড়া জোয়ান এইখানে আছিস এই পুঁচকে মেয়ে করবেটা কী?”
“এরে বিশ্বাস নাই। এর মতো ত্যাঁদড় মেয়ের কথা আমি আমার বাপের জন্মে শুনি নাই?”
“ত্যাঁদড়ামি এক্ষুণি শেষ হবে! খুলে দে।”
মানুষটা একটু বিরক্ত হয়ে রাশার হাতের বাঁধন খুলে দিল। রাশা তার হাত দুটো সামনে এনে তাকায়, একেবারে নীল হয়ে গেছে। সে আঙুলগুলো খুলল, তারপর বন্ধ করল। হাতের মাঝে রক্ত চলাচল শুরু হয়েছে, আঙুলগুলোতে কেমন কাঁটা দিয়ে উঠছে। রাশা এবারে নিচে থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই মানুষ দুজন তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, “কী করিস? কী করিস তুই?”
রাশা বলল, “আমি একটু বেঞ্চের ওপর ঠিক করে বসব।”
একজন ভেংচে উঠে বলল, “ওরে আমার শাহজাদি! তার বেঞ্চের ওপর বসতে হবে। নিচে থেকে উঠবি না খবরদার।”
রাশা আর ওঠার চেষ্টা করল না। পাটাতনে বসে পানির বোতলটা হাতে নিয়ে তার ছিপি খুলে সে মুখে বোতলটা লাগিয়ে ঢকঢক করে পানিটা খেল। তার মনে হলো তার বুকটা যেন একটা জ্বলন্ত চুলোর মতো হয়ে। আছে, পুরো পানিটা সেটা যেন মুহূর্তে শুষে নিল। পানির শেষ বিন্দুটা খেয়ে সে খালি বোতলটা নিচে নামিয়ে রাখে আর ঠিক তখন তার মাথায় বিদ্যুৎ ঝলকের মতো একটা চিন্তা খেলে যায়। এদের হাত থেকে ছাড়া পাবার একটা সুযোগ এসেছে অত্যন্ত কঠিন কিন্তু তবু একটা সুযোগ। হাতে ধরে রাখা এই এক লিটারের খালি প্লাস্টিকের বোতলটাই হচ্ছে সেই সুযোগ। তার শেষ সুযোগ। তার জীবন বাঁচানোর সুযোগ। রাশা তার বুক থেকে একটা নিশ্বাস খুব সাবধানে বের করে দিল।
রাশা মুহূর্তের মাঝে পরিকল্পনাটা ঠিক করে ফেলে। প্লাস্টিকের বোতলটার তলাটা আলাদা করতে হবে। কাজটা কঠিন কিন্তু অসম্ভব না। মানুষগুলোর মনে কোনো সন্দেহ না জাগিয়ে কাজটা করতে হবে। রাশা বোতলটা হাতে ধরে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে নাড়তে থাকে। একজন মানুষ নার্ভাস হলে যেরকম করে অনেকটা সেরকম। মানুষগুলোকে ব্যস্ত রাখার জন্য কোনো একটা বিষয় নিয়ে কথা বলারও দরকার। রাশা কী বলবে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, “আপনারা আমাকে কেন ধরে এনেছেন?”