রাশাকে এত জোরে পাটাতনে চেপে ধরে রেখেছে যে রাশার মনে হলো তার শরীরের হাড়গোড় ভেঙে যাবে, তার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু এই মুহূর্তে রাশা সেগুলো ভালো করে বুঝতেও পারছিল না যে ভয়ঙ্কর একটা বিপদের মাঝে পড়েছে, সেটা তার সমস্ত চিস্তা করার ক্ষমতাকে শেষ করে দিয়েছে। তার মনে হচ্ছে সে একটা ঘোরের মাঝে আছে, মনে হচ্ছে চারপাশে যা ঘটছে তার সবকিছু বুঝি একটা দুঃস্বপ্ন। মনে হচ্ছে এক্ষুণি সে জেগে উঠবে তখন দেখবে এই সবকিছু আসলে মিথ্যা আসলে কিছুই হয়নি।
কিন্তু রাশা জানে এটা দুঃস্বপ্ন না। রাশা জানে যা ঘটছে তার সবকিছু সত্যি। রাশা জানে এখান থেকে বেঁচে ফিরে আসাটা হবে একটা অলৌকিক ঘটনা।
.
এভাবে কতক্ষণ কেটেছে ঠিক জানে না, হঠাৎ একসময় রাশা শুনতে পেল ট্রলারের ইঞ্জিনটার শব্দ কমে এলো। তাকে যেখানে আনার কথা মনে হয় তাকে সেখানে নিয়ে এসেছে। ট্রলারটার গতিও কমতে কমতে একসময় পুরোপুরি থেমে গেল। রাশা শুনতে পেল, যে মানুষটা তাকে চেপে ধরে রেখেছে সে কাউকে বলছে, “পাড়ে লাগাস না। এখানেই থামা।”
“এখানেই থামাব?”
“হ্যাঁ, পাড়ে লাগালেই কেউ না কেউ দেখে ফেলবে, আর একটা ঝামেলা হবে।”
“ঠিক আছে, একটা লগি মেরে ট্রলারটা রাখি।”
রাশা টের পেল ট্রলারটাকে নদীর মাঝখানে কোথাও থামিয়ে লগি দিয়ে আটকে ফেলা হলো।
অন্য মানুষটা জিজ্ঞেস করল, “হুজুর কখন আসবেন?”
যে মানুষটা রাশাকে চেপে ধরে রেখেছে সে বলল, “হুজুর আসবেন না। অন্ধকার হলে আমরা নিয়ে যাব।”
“এতক্ষণ এই ছেমড়িকে কী করব?”
“বেন্ধে রেখে দেব। এর তড়পানি বড় বেশি, কখন কী করে তার ঠিক নাই।”
লোকটা রাশার চুলের খুঁটি ধরে টেনে তুলল। গরু জবাই করার চাকুটা তার নাকের সামনে দিয়ে একবার ঘুরিয়ে এনে বলল, “একটু তেড়িবেড়ি করবি তো জবাই করে ফেলব। বুঝেছিস?”
রাশা কোনো কথা বলল না। মানুষটা তখন কোথা থেকে একটা ময়লা গামছা এনে তার মুখটা বেঁধে ফেলল, যেন সে চিৎকার করতে না পারে। তারপর আরেকটা গামছা দিয়ে হাতটা পিছনে নিয়ে ট্রলারের বেঞ্চের পায়ার সাথে শক্ত করে বেঁধে ফেলল। বাঁধনটা পরীক্ষা করে মুখে সন্তুষ্টির একটা শব্দ করে বলল, “এখন ঠিক হয়েছে। চুপ করে বসে থাক।”
রাশার কিছু করার ছিল না, তাকে চুপ করে বসেই থাকতে হলো। ভয়ঙ্কর একধরনের আতঙ্কে তার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে, সে কী করবে বুঝতে পারছে না। চোখ বন্ধ করে সে মনে মনে বলল, “হে খোদা! বাঁচাও তুমি। আমাকে বাঁচাও। তুমি ছাড়া আর কেউ আমাকে এখন বাঁচাতে পারবে না। কেউ না।”
.
ঠিক এই সময় জয়নব, মতি, জিতু আর অন্যেরা সালাম নানার কাছে গিয়ে হাজির হয়েছে। জয়নব হাউমাউ করে কাঁদছে, গুছিয়ে কথাও বলতে পারছে না। মতি আর জিতুও একসাথে কথা বলতে চাইছে–সালাম নানা কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। একটু অধৈর্য হয়ে বললেন, “তোমাদের ভেতর যে কোনো একজন কথা বলো। যে কোনো একজন।”
তখন মতি বলল, “রাশা আপুকে ধরে নিয়ে গেছে!”
সালাম নানা চমকে উঠলেন, “কে ধরে নিয়ে গেছে?”
“একটা ট্রলার এসে আমাদের নৌকাটাকে ধাক্কা দিয়েছে, আমরা সবাই তখন পানিতে পড়ে গেছি। পানি থেকে উঠে দেখি রাশা আপু নাই।”
“হয়তো রাশা ব্যথা পেয়েছে, ডুবে গেছে।”
জিতু বলল, “ডুবে নাই। আমরা পুরো জায়গাটা খুঁজে দেখেছি, রাশা আপু নাই। তার ব্যাগটাও পেয়েছি।”
মতি বলল, “ট্রলারের মাঝে যে দুইটা লোক ছিল তারা সবসময় আমাদের পিছে পিছে হাঁটত। রাশা আপু কোনজন আমাদের সেটা জিজ্ঞেস করত।”
সালাম নানা আতঙ্কিত গলায় বললেন, “সর্বনাশ!”
জয়নব হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “এখন কী হবে? রাশার এখন কী হবে?”
সালাম নানা ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “পুলিশকে খবর দিতে হবে। ট্রলারটাকে খুঁজে বের করতে হবে। কোনদিকে গিয়েছে?”
“উত্তর দিকে। মনে হয় মাতাখালি নদীর দিকে।”
“মাতাখালি! সর্বনাশ!”
জয়নব কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করল, “কেন? সর্বনাশ কেন?”
সালাম নানা বললেন, “মাতাখালি নদীর পাড়েই তো আহাদ আলী রাজাকারের বাড়ি।
.
রাশা বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে দেখল, হাতটাকে ছুটিয়ে আনা যায় কিনা–পারল না। এত শক্ত করে বেঁধেছে যে কোনোভাবেই সেটা দিলে করা সম্ভব হলো না। তার মনে হতে লাগল বুঝি হাতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে। হাতটাকে একটু পরপর নেড়ে সে রক্ত চলাচল চালু রাখছে। মুখের মাঝে ময়লা গামছাটা দিয়ে বেঁধেছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছে বাতাসের অভাবে বুঝি বুকটা ফেটে যাবে। যা তৃষ্ণা পেয়েছে সেটা বলার মতো নয় মনে হচ্ছে এক ফোঁটা পানির জন্যে সে তার জীবনটা দিয়ে দিতে পারবে।
ট্রলারের ছাদে মানুষ দুজন বসে আছে, মাঝে মাঝে নিচে এসে দেখে যাচ্ছে সবকিছু ঠিক আছে কিনা। তাদের টুকরো টুকরো কথাবার্তা রাশা নিচে বসে শুনতে পাচ্ছে। হঠাৎ শুনল একজন উত্তেজিত গলায় বলল, “আরে! আরে! হুজুর নিজেই দেখি চলে আসছেন!”
অন্যজন বলল, “অন্ধকার হওয়ার পর ছেমড়িটাকে হুজুরের কাছে নেওয়ার কথা ছিল না?”
“তাই তো কথা ছিল। দেখি ব্যাপারটা কী?”
রাশা একটু পরে শুনতে পেল একটা নৌকা এসে ট্রলারের গায়ে লাগল, তারপর নৌকা থেকে একজন ট্রলারে উঠল। একজন বলল, “হুজুর, আপনি নিজেই চলে এসেছেন? অন্ধকার হলে আমরাই তো ছেমড়িটাকে নিয়ে যেতাম।”