রাশা হেসে বলল, “তুই কী করবি?”
“আমি জানে মেরে ফেলব?”
জিতু বলল, “রাশাপু আমিও থাকব তোমার সাথে। আমিও জানে মেরে ফেলব?”
রাশা হি হি করে হেসে বলল, “তোদের মতো দুইজন বডিগার্ড থাকলে আমার আর চিন্তা কিসের?”
কথা বলতে বলতে তারা নৌকাটায় উঠেছে। যে যার জায়গায় বসার পর মতি লগি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে নৌকাটাকে নদীর পানিতে নিয়ে এসেছে। তারপর বৈঠা বেয়ে সাবধানে নদীটা পার হয়েছে। নদীর কিনারা ধরে এগিয়ে গিয়ে ছোট খালটা দিয়ে বিলে ঢুকেছে। বিলের পানি ধীরে ধীরে কমে আসছে, জায়গায় জায়গায় শুকনো মাটি বের হয়েছে, সেখানে সাদা ধবধবে কাশফুল। বাতাসে কাশফুলগুলো মাথা নাড়ছে দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।
অন্যান্য দিনের মতোই বিলটা নির্জন, শুধু অনেক দূরে একটা ট্রলার; তার ইঞ্জিনের শব্দ এত দূর থেকেও শোনা যাচ্ছে। বিলের ভেতর এসে রাশা মতির কাছ থেকে বৈঠাটা নিয়ে পিছনে বসেছে। বৈঠাটাকে হালের মতো করে ধরেছে, মতি আর জিতু তখন মোটামুটি প্রতিযোগিতা করে বৈঠা বাইছে, নৌকাটা তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে। বেশ খানিকদূর এগিয়ে যাবার পর তারা লক্ষ করল ট্রলারটা বিশাল বিল পাড়ি দিয়ে ঠিক তাদের দিকেই আসছে, এতক্ষণে সেটা অনেক কাছে চলে এসেছে। ট্রলারের
ইঞ্জিনের বিকট শব্দটা এখন রীতিমতো কানে লাগছে।
মতি বলল, “এই ট্রলারটা কই যায়?”
“ জিতু বলল, “মনে হয় নদীতে।”
“আসছে কোথা থেকে?”
“কে জানে, কোথা থেকে আসছে।”
পুরো বিলে আর কোথাও কেউ নেই শুধু তাদের নৌকাটা আর এই ট্রলার, তাই তারা কৌতূহলী হয়ে ট্রলারটার দিকে তাকিয়ে রইল।
ট্রলারের ইঞ্জিনটা হঠাৎ আরো জোরে গর্জন করে উঠে, রাশা লক্ষ করল সেটা এখন সোজাসুজি তাদের দিকে ছুটে আসছে। রাশা চিন্তিত মুখে বলল, “ট্রলারটা আমাদের দিকে কেন আসছে?”
জয়নব বলল, “বুঝতে পারছি না।”
মতি হাতে একটা লগি তুলে নিয়ে বলল, “নিশানা ভালো মনে হচ্ছে না। মনে হয় খারাপ মতলব আছে।”
রাশার বুকটা ধক করে উঠল, ট্রলারটা কী করতে চাইছে? ঠিক এরকম সময় রাশা দেখল দুজন মানুষ ট্রলারের ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে। তারা অনেকবার মানুষগুলোকে দেখেছে, এই মানুষগুলো অনেক দিন থেকে তাদের পিছনে ছায়ার মতো ঘুরে বেড়িয়েছে।
মতি বলল, “রাশা আপু, তুমি ভয় পেয়ো না। আমি আছি।”
রাশা মতির দিকে তাকাল, শুকনা কাঠির মতো কালো দড়ি পাকানো শরীর, দুজন জোয়ান মানুষের সাথে সে কী করবে? রাশা বলল, “নৌকাটাকে বিলের কিনারে নিয়ে যাই। ঐ কাশবনের কাছে শুকনায়।“
“ঠিক আছে।”
রাশা নৌকাটাকে ঘুরিয়ে নিল। মতি আর জিতু প্রাণপণে বৈঠা চালিয়ে নৌকাটাকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। তখন তারা আতঙ্কিত হয়ে দেখে ট্রলারটাও একটু ঘুরে সোজা তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। এখন আর তাদের মনে কোনো সন্দেহ নেই এই ট্রলারটা তাদেরকে ধরার জন্যেই এসেছে। দেখতে দেখতে সেটা তাদের ওপর ওঠে এলো। কী করবে বুঝে উঠার আগেই ট্রলারটা তাদের নৌকাকে একপাশ থেকে ধাক্কা দিল, সাথে সাথে নৌকায় যারা ছিল তারা বিলের পানিতে ছিটকে পড়ল! ট্রলারের বিকট গর্জন তার সাথে সবার চিৎকার মুহূর্তের মাঝে পুরো পরিবেশটা নারকীয় হয়ে ওঠে।
ট্রলারটা থামল না, নৌকাটাকে ধাক্কা দিয়ে সোজা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। পিছনে নৌকায় যারা আছে তাদের কার কী হয়েছে জানার জন্যে কোনো কৌতূহল নেই। বিলের পানির ভেতর থেকে প্রথমে জয়নব, তারপর মতি ভেসে উঠল। জিতুও একটু পরে সাঁতার কেটে তাদের কাছে এলো। সাথে আরো দুজন ছিল তারাও পানি থেকে ভেসে উঠেছে, কিন্তু রাশা নেই। জয়নব আতঙ্কিত হয়ে ডাকল, “রাশা, রাশা!”
কেউ উত্তর দিল না। মতি তখন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করল, “রাশা আপু! রাশা আপু!”
এবারেও কেউ উত্তর দিল না।
বিলের পানিতে ভেসে থাকতে থাকতে সবাই এদিক-সেদিক তাকায়, কোথাও রাশার চিহ্ন নেই।
জয়নব ভাঙা গলায় বলল, “কোথায় গেল রাশা? কোথায়?”
.
ঠিক সেই মুহূর্তে একটা মানুষ রাশাকে ট্রলারের পাটাতনে চেপে ধরে রেখেছে। তার হাতে গরু জবাই করার একটা ছুরি, ট্রলারের ইঞ্জিনের বিকট আওয়াজ ছাপিয়ে সে চিৎকার করে রাশাকে বলল, “এই মেয়ে, তুই যদি উল্টাপাল্টা কিছু করিস, এই ছুরি দিয়ে জবাই করে দেব।”
রাশা উল্টাপাল্টা কিছু করার চেষ্টা করল না, মানুষটার চেহারা, চোখের দৃষ্টি, কথা বলার ভঙ্গি সবকিছুই আশ্চর্য রকম নিষ্ঠুর। রাশা বুঝতে পারে সত্যি সত্যি একজন মানুষকে জবাই করা তার জন্যে বিন্দুমাত্র কঠিন ব্যাপার না।
মানুষটা বলল, “তোরে এখনই জবাই করে বিলের মাঝে পুঁতে ফেলা উচিত ছিল। হুজুর তোরে নিজের চোখে একবার দেখতে চাচ্ছেন তাই নিয়ে যাচ্ছি। খবরদার কোনো তেড়িবেড়ি করবি না।”
রাশার কাছে পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হতে থাকে। হুজুর মানে নিশ্চয়ই রাজাকার আহাদ আলী। এই মানুষগুলো তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে অহাদ আলীর কাছে। ট্রলারটা দিয়ে যখন নৌকাটাকে ধাক্কা দিয়েছে তখন অন্য সবার সাথে সেও পানিতে ছিটকে পড়েছে, সাঁতার দিয়ে পানিতে ভেসে উঠার আগেই সে টের পেল লোহার মতো শক্ত দুটো হাত তাকে ধরে ফেলেছে, রাশা চিৎকার করার চেষ্টা করল, কিন্তু ইঞ্জিনের বিকট আওয়াজে সেটা চাপা পড়ে গেল। কিছু বোঝার আগে তাকে হ্যাঁচকা টানে তুলে ট্রলারের পাটাতনে চেপে ধরেছে। কয়েক সেকেন্ডের মাঝে সবকিছু ঘটে গেছে, রাশা কিছু বুঝে ওঠারও সময় পেল না।