“শামসু মিয়াটা কে?
“ঐ যে তোমার খাতা ক্যান্সেল করে দিল। ব্যাটা রাজাকারের বাচ্চা রাজাকার। এখন চাকরি চলে যাবে দেখো। কত বড় সাহস।”
জাহানারা ম্যাডাম রাশাকে বুকে জড়িয়ে বললেন, “বুঝলে রাশা, তোমাকে দেখে গর্বে আমার বুক ফুলে যাচ্ছে। তোমার মতোন দুই-একজন ছাত্রী পেলেই আমাদের জীবনটা কমপ্লিট হয়।”
হেডমাস্টার বললেন, “রাশা আসলে আমাদের স্কুলের ছাত্রী। আমি হচ্ছি হেডমাস্টার। আমাদের স্কুলের নামটা নিয়ে একটু সমস্যা আছে কথা সত্যি। কিন্তু স্কুল ভালো। কম্পিউটারই আছে তিরিশটা। বি.এস.সি. শিক্ষক তিনজন। আমার নাম কফিলউদ্দিন বি,এড।”
জাহানারা ম্যাডাম হাসলেন, বললেন, “আপনার স্কুল নিশ্চয়ই খুব ভালো, তা না হলে এরকম ছাত্রী কোথা থেকে তৈরি হয়?”
১৪. আহাদ আলী রাজাকার
কোনোরকম অনুষ্ঠান ছাড়াই একদিন স্কুলের পুরানো সাইনবোর্ড নামিয়ে নতুন একটা সাইনবোর্ড লাগানো হলো, সাইনবোর্ডে বড় বড় করে লেখা ‘শহীদ রায়হান উচ্চ বিদ্যালয়’। রায়হান পাশের গ্রামের ছেলে, একাত্তরে কলেজে পড়ত, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হতেই সে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। ট্রেনিং নিয়ে আর এখানেই ফিরে এসেছে, এখানে মিলিটারির সাথে সামনাসামনি যুদ্ধ করে মারা গেছে, তখন তার বয়স বিশ বছরও হয়নি। হেডমাস্টার অনেক খোঁজাখুঁজি করে রায়হানের একটা ছবি জোগাড় করেছেন, দেখে মনে হয় বাচ্চা একটা ছেলে, মুখ টিপে হাসছে! ছবিটা বড় করানোর কারণে সেটা বেশ ঝাঁপসা হয়ে গেছে, সেই ছবিটাই বাঁধাই করে হেডমাস্টারের অফিসে রাখা হয়েছে।
প্রতিদিন যখন স্কুলে আসে তখন অনেক দূর থেকে রাশার মুখে হাসি ফুটে ওঠে, রাজাকার আহাদ আলীর নামটা তাকে আর কোনোদিন বলতে হবে না, এটা চিন্তা করেই রাশার মনটা ভরে ওঠে। তার সবচেয়ে বেশি জানতে ইচ্ছে করে আহাদ আলী রাজাকারটা এখন কী করছে। লোকজনের কাছে কানাঘুষা শুনেছে যে সে নাকি মামলা করবে, করলে করুক। রাশার কোনো মাথা ব্যথা নেই।
কয়েকদিন পর তারা যখন সবাই নৌকা করে ফিরে আসছে তখন মতি বলল, “রাশা আপু। তোমার মনে হয় একটু সাবধান থাকা দরকার।”
রাশা অবাক হয়ে বলল, “আমার সাবধান থাকা দরকার? কেন?”
“আহাদ আলী রাজাকার খুবই ডেঞ্জারাস। তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারে।”
“আমার কী ক্ষতি করবে?”
“সেইটা জানি না। কিন্তু তোমার সাবধান থাকা দরকার।”
মতি কম কথা বলে, কাজেই সে যদি রাশাকে সাবধান থাকতে বলে তাহলে সেটা খুবই গুরুতর কথা। রাশা জিজ্ঞেস করল, “কোনো কিছু কি হয়েছে?”
“বলতে পারো হয়েছে।”
“কী হয়েছে?”
“সেইদিন আমরা স্কুলে যাচ্ছি তখন একটা মানুষ আমাকে ডেকে নিল, ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, এইখানে রাশা কোন মেয়েটা।”
“তুই কী বললি?”
“আমি বলেছি আমি চিনি না।”
জয়নব বলল, “বেশ করেছিস। কোনো কথা বলার দরকার নাই।”
“আমি তো বলি না, কিন্তু কেউ না কেউ তো বলে দিবে।”
“তা ঠিক।”
মতি বলল, “রাশা আপু, তুমি কখনো একা বের হবে না।”
রাশা বলল, “আমি একা আর কোথায় যাই। সবসময়েই তো একসাথেই থাকি।”
জয়নব বলল, “হ্যাঁ এখন থেকে আরো বেশি একসাথে থাকতে হবে।”
নৌকা চালিয়ে ওরা নদী থেকে বিলে ঢুকল, মোটামুটি নির্জন বিল, অনেক দূরে দূরে একটা-দুইটা জেলে নৌকা মাছ ধরছে। এ ছাড়া কোথাও কোনো জনমানুষ নেই। রাশার দেখে বিশ্বাসই হয় না যে শীতকালে প্রায় পুরো বিলটাই শুকিয়ে যাবে, এখন যেখানে পানি, তখন সেখানে হবে ধানক্ষেত।
.
রাশা কয়েকদিন পর লক্ষ করল তারা সবাই যখন স্কুল থেকে বের হয়ে হেঁটে হেঁটে নৌকা ঘাটে যাচ্ছে তখন একজন মানুষ তাদের পিছনে পিছনে হাঁটতে লাগল। তারা যখন নৌকায় উঠে রওনা দিয়েছে তখন তার সাথে আরো দুজন লোক এসে যোগ দিল, তারপর তারা তিনজন তাদের নৌকার দিকে তাকিয়ে রইল। লোকগুলোর কী উদ্দেশ্য কে জানে কিন্তু রাশার পুরো ব্যাপারটাকেই কেমন যেন রহস্যময় মনে হয়, কেমন যেন সন্দেহজনক মনে হয়। তার বুকের ভেতর কেমন যেন একধরনের দুশ্চিন্তা এসে ভর করে।
শুধু যে রাস্তায় তাদের পিছু পিছু অপরিচিত মানুষ হাঁটে তা নয়, স্কুলের ভেতরেও মাঝে মাঝে অপরিচিত মানুষ এসে ক্লাসের ভেতর উঁকি দিতে লাগল। মানুষগুলো কী করতে চায় কে জানে। রাশা কাউকে ঠিক করে বলতেও পারছিল না, কী করবে বুঝতে পারছিল না। একবার ভাবল হেডমাস্টারকে জানাবে, কিন্তু তাকে জানিয়ে কী লাভ? সালাম নানাকে জানিয়ে রাখলে হয়, কিন্তু রাশা তার পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত, সালাম নানার সাথে দেখা করারই সময় পাচ্ছিল না।
.
সেদিন সবাই দল বেঁধে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে আসছে, রাশা চোখের কোনা দিয়ে লক্ষ করে দেখার চেষ্টা করল, কেউ তাদের পিছু নিয়েছে কিনা, কাউকে দেখল না। তখন সে গলা নামিয়ে বলল, “আমাদের সমস্যাটা কী জানিস?”
জয়নব জিজ্ঞেস করল, “কী?”
“আমরা প্রত্যেক দিন একইভাবে যাই আর আসি। তাই কেউ যদি আমাদের ধরতে চায় তাহলে সে জানে তাকে ঠিক কী করতে হবে। কোথায় আমাদের ধরতে হবে।”
“তাহলে আমাদের কী করতে হবে?”
“একেক দিন একেক দিক থেকে স্কুলে আসতে হবে। আবার একেক দিন একেক পথ দিয়ে স্কুল থেকে বাড়িতে যেতে হবে।”
মতি বলল, “তুমি চিন্তা করো না রাশা আপু। আমি সবসময় তোমার সাথে থাকব। কেউ তোমারে কিছু করতে পারবে না। আমার জান থাকতে কেউ তোমার গায়ে হাত দিতে পারবে না।”