রাশা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ।”
মেয়েটার তখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, আবার জিজ্ঞেস করল, “সত্যি?”
“হ্যাঁ সত্যি!”
তখন মেয়েটি একটা গগনবিদারি চিৎকার দিল যেন রাশা নয় আসলে তাকেই স্টেজে ডাকা হচ্ছে। সে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল তারপর রাশাকে জাপটে ধরে প্রায় কোলে তুলে নিয়ে চিৎকার করতে করতে স্টেজের দিকে ছুটতে থাকে। রাশা অপ্রস্তুত হয়ে মেয়েটার কবল থেকে ছোটার চেষ্টা করল কিন্তু মেয়েটি তাকে ছাড়ল না, একেবারে স্টেজের সামনে তাকে নামিয়ে দিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগল। দৃশ্যটি দেখার জন্যে প্যান্ডেলের প্রায় সবাই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এবার তারা বসতে শুরু করে।
মন্ত্রী রাশার হাত ধরে স্টেজে নিয়ে এসে বললেন, “মা, আমি তোমাকে একটা পুরস্কার দিতে চাই। তুমি বলো কী পুরস্কার চাও।”
মন্ত্রী মাইক্রোফোনটা রাশার মুখে ধরলেন, রাশা বলল, “আমি আমার পুরস্কার পেয়ে গেছি। এই যে আপনি আমাকে এখানে ডেকে এনেছেন এটাই আমার পুরস্কার।”
“তারপরেও তোমাকে একটা পুরস্কার দিতে চাই। বলো।”
“আপনি আমার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে দেন।”
সামনে যারা বসেছিল কোনো একটা কারণে সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠল। মন্ত্রী বলল, “অবশ্যই মা, অবশ্যই আমি তোমার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে দেব।”
রাশা দেখল বুড়ো বুড়ো প্রফেসর মন্ত্রীর পিছনে এসে ভিড় করে উসখুস করছে। একজন গলা উঁচিয়ে বলল, “স্যার আসলে একটা মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গেছে, আমরা আসলে মেয়েটাকে একটা স্পেশাল প্রাইজ দিতে চাই।”
মন্ত্রী মহোদয় হাত দিয়ে পুরো ব্যাপারটি উড়িয়ে দিয়ে বললেন, “কোনো প্রয়োজন নাই! এই মেয়েটি আপনাদের পুরস্কার ছাড়াই অনেকদূর যাবে বলে মনে হচ্ছে!”
বুড়ো প্রফেসর বলল, “কিন্তু স্যার–”
মন্ত্রী হাত নেড়ে বুড়ো প্রফেসরকে বাতিল করে দিয়ে রাশার দিকে তাকালেন, বললেন, “মা, আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি না। তুমি এইটুকুন বাচ্চা মেয়ে এই রকম কঠিন কঠিন অঙ্ক করে ফেল, কিন্তু খাতার উপরে স্কুলের নাম লিখতে ভুলে গেলে এটা কী রকম কথা?”
রাশা বলল, “আমি ভুলি নাই।”
“তাহলে?”
“আমি ইচ্ছা করে লিখি নাই।”
“কেন?”
“আমাদের স্কুলের নামটা একটা রাজাকারের নামে। আমার নানা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, এই রাজাকার আমার নানাকে মেরেছে। আমি মরে গেলেও কোথাও এই রাজাকারের নাম লিখব না।”
মন্ত্রী কেমন যেন একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে রাশার দিকে তাকিয়ে থাকলেন, এতক্ষণ হাতের মাইক্রোফোনে কথা বলছিলেন, এখন মাইক্রোফোনটা টেবিলে রেখে রাশাকে কাছে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “মা, আমিও একজন মুক্তিযোদ্ধা। সেভেন্টি ওয়ানে আমার অনেক বন্ধু মারা গেছে। রাজাকাররা মেরেছে–আমি মূর্খ মানুষ, লেখাপড়া করি নাই। আমার বন্ধুরা সব ট্যালেন্টেড ছেলে ছিল, বেঁচে থাকলে আজকে কত বড় বড় মানুষ হতো!”
মন্ত্রী রাশার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “মা, আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, একসপ্তাহের মাঝে আমি তোমার স্কুলের নাম বদলে দেব। রাজাকারের নাম সরিয়ে একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম দিব। এই স্কুলের সবচেয়ে কাছাকাছি এলাকায় শহীদ হয়েছে সে রকম একজন মুক্তিযোদ্ধার নামে। ঠিক আছে?”
মন্ত্রী এমনভাবে রাশাকে জিজ্ঞেস করলেন, যেন তার কথার উপরেই সবকিছু নির্ভর করছে।
রাশা বলল, “ঠিক আছে। আপনাকে থ্যাংকু। অনেক থ্যাংকু।” তারপর কাজটা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারল না তারপরও করে ফেলল, মন্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলল, “আমার মনে আর কোনো দুঃখ নাই?”
স্টেজে যারা উপস্থিত ছিল, সামনে যারা বসে আছে তারা সবাই বুঝতে চাইছিল ঠিক কী হচ্ছে। মন্ত্রী তাই মাইকটা হাতে নিয়ে বললেন, “আমি এই মায়ের কাছে ছোট একটা ওয়াদা করেছি। তার স্কুলের নামটা আমি বদলে দিব। সেই নামটা দেয়া হবে একটী শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামে। আমার এই ছোট মা তখন বুক ফুলিয়ে সবার কাছে তার স্কুলের নামটা বলতে পারবে।”
.
স্টেজ থেকে নামার পর অনেকগুলো টেলিভিশন ক্যামেরা রাশাকে ঘিরে ধরল, রাশা দেখল তাদের হেডস্যার সবাইকে ঠেলে রাশার পিছনে দাঁড়িয়ে গেলেন। একজন সাংবাদিক জিজ্ঞেস করল, “তুমি যে সবচেয়ে ভালো করেও সায়েন্স অলিম্পিয়াডে পুরস্কার পেলে না সে জন্যে তোমার কি মন খারাপ হয়েছে?”
রাশা মাথা নাড়ল, “না একটুও মন খারাপ হয়নি। আমার স্কুলে আর রাজাকারের নাম থাকবে না এইটা আমার সবচেয়ে বড় পুরস্কার।”
হেডস্যারকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেনি কিন্তু তিনি নিজে থেকে যোগ করলেন, “আমাদের স্কুলের নাম নিয়ে একটু সমস্যা আছে কথা সত্যি কিন্তু স্কুলটা খুব হাইফাই। তিরিশটা কম্পিউটার আছে। আমি হচ্ছি হেডমাস্টার কফিলউদ্দিন বি.এড।”
সাংবাদিকরা রাশাকে ঘিরে তাকে প্রশ্ন করতে লাগল, রাশা চেষ্টা করল শান্তভাবে উত্তর দিতে। মাঝে মাঝে তার একটু নার্ভাস লাগছিল, কিন্তু সে লক্ষ করল কাছেই জাহানারা ম্যাডাম দাঁড়িয়ে আছেন, তার পাশে মিমি। এই দুজনকে দেখেই তার সাহস বেড়ে গেল, সে তখন বেশ গুছিয়েই সব প্রশ্নের উত্তর দিল।
সাংবাদিকরা চলে যাবার পর রাশা ছুটে গিয়ে মিমির হাত ধরে বলল, “মিমি আপু! আপনাকে যে আমি কিভাবে থ্যাংকু দিব! ইস!”
মিমি হি হি করে হেসে বলল, “আচ্ছা শিক্ষা হয়েছে শামসু মিয়ার।”