“না। আগেই এসেছিলাম একটু বাইরে গিয়েছিলাম।”
“ও।“
রাশা ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, “প্রাইজ দিয়ে দিয়েছে তো, তাই না?”
“না। এখনো দেয়নি।”
রাশা চমকে উঠল, “এখনো দেয়নি?”
“নাহ্। সবাই লম্বা লম্বা বক্তৃতা দিচ্ছে।”
“এখনো প্রাইজ দেয়নি?”
“এক্ষুণি দেবে, ঐ যে দেখো প্রাইজ আনছে।”
রাশা দেখল স্টেজে টেবিলের ওপর অনেকগুলো মেডেল এনে রাখা হচ্ছে। একটি মেয়ে হাতে কিছু কাগজপত্র নিয়ে স্টেজে উঠে ব্যস্তভাবে অন্য একজনের সাথে কথা বলছে। রাশার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল, তার লাফ দিয়ে উঠে ছুটে পালিয়ে যাবার ইচ্ছে করছিল কিন্তু সে উঠতে পারল না। এখন আর উঠে পালিয়ে যাবার উপায় নেই। যে দৃশ্যটা দেখার জন্যে সে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল এখন তাকে বসে সেই দৃশ্যটি দেখতে হবে। সে ঘুরে ঘুরে সেই দৃশ্যটি দেখার জন্যেই ফিরে এসেছে। খোদা এত নিষ্ঠুর কেন কে জানে! রাশ মাথা নিচু করে বসে রইল।
মেয়েটি মাইকে একজন একজন করে নাম ডাকতে থাকে, যার নাম ডাকা হয়েছে সে আনন্দে চিৎকার করে নাচতে নাচতে স্টেজে যায়। আধা পাকা চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, খোঁচা খোঁচা গোঁফ একজন মানুষ পুরস্কার দিতে থাকে। এই মানুষটা নিশ্চয়ই একজন মন্ত্রী হবে, সে শুনেছিল পুরস্কার দেয়ার জন্য একজন মন্ত্রী আসবেন।
বারোজনকে সেকেন্ড রানারআপ পুরস্কার দেয়া হলো। তারপর আরো বারোজন পেল রানারআপ পুরস্কার। শেষে ছয়জন পেল চ্যাম্পিয়ন পুরস্কার। যারা পুরস্কার পেয়েছে তাদের বেশিরভাগই ছেলে, হাতেগোনা। অল্প কয়জন মাত্র মেয়ে। যতটুকু যন্ত্রণা হবে বলে ভেবেছিল রাশা আবিষ্কার করল তার ততটুকু যন্ত্রণা হলো না, ভেতরটা কেমন যেন ভোঁতা হয়ে আছে, মনে হচ্ছে কিছুই টের পাচ্ছে না। সে নিঃশব্দে বসে আছে, এক্ষুণি অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে ঘোষণা করা হবে তখন সবার সাথে সাথে সে উঠে দাঁড়াবে তারপর হেঁটে চলে যাবে। কিন্তু ঘোষণাটি করা হলো না আর রাশা ভেতরে ভেতরে অধৈর্য হয়ে বসে রইল।
পাশে বসে থাকা ঝকঝকে চেহারার মেয়েটা বলল, “কিছু একটা ঘাপলা হয়েছে।”
রাশা মাথা তুলে তাকাল, “কী ঘাপলা?”
“ঐ দেখো। একটা মেয়ে হাতে একটা কাগজ নিয়ে চেঁচামেচি করছে। সবাই তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।”
রাশা চোখ তুলে তাকাল, মিমি নামের মেয়েটা হাতে একটা খাতা নিয়ে কথা বলছে, অন্যেরা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। রাশা সাথে সাথে বুঝে গেল কী হয়েছে, মিমির হাতে যে খাতাটা, সেটা হচ্ছে তার পরীক্ষার খাতা, সে এই খাতাটা নিয়ে স্টেজে চলে এসেছে, সবাইকে নিশ্চয়ই বলছে যে একটা খুব বড় অবিচার করা হয়েছে। হঠাৎ করে রাশার দুই চোখে পানি চলে এলো।
মন্ত্রী চেঁচামেচি শুনে খুব বিরক্ত হলেন মনে হলো, হাত দিয়ে ইঙ্গিত করে বললেন মিমিকে তার কাছে পাঠাতে। মিমি মন্ত্রীকে খাতাটা দেখাল, হাত-পা নেড়ে উত্তেজিতভাবে কিছু বলল, মন্ত্রীও খাতাটা দেখলেন তারপর মাথা নাড়লেন। বুড়ো মানুষগুলোও মন্ত্রীর কাছে চলে এসেছে, তারাও কিছু একটা বোঝাচ্ছে, মন্ত্রী মনে হয় তাদের কথাও শুনলেন, তারপরে মাথা নাড়লেন।
পাশে বসে থাকা মেয়েটা বলল, “কী হচ্ছে বলে মনে হয়?”
রাশা বলল, “একটা খাতা পাওয়া গেছে যেখানে একজন অনেক মার্কস পেয়েছে কিন্তু তাকে কোনো পুরস্কার দেয় নাই।”
“তুমি কেমন করে জানো?”
“জানি না। আন্দাজ করছি।”
রাশা দেখল হঠাৎ মন্ত্রী উঠে দাঁড়ালেন, হাতে মাইকটা নিয়ে বললেন, “আমি একটা ছোট ঘোষণা দিতে চাই। এই যে আজকে সায়েন্স অলিম্পিয়াড হলো, দেশের বড় বড় বৈজ্ঞানিক, প্রফেসর মিলে সেটা আয়োজন করেছেন, তাদের নিয়ম-কানুনমতো খাতা দেখা হয়েছে পুরস্কার দেয়া হয়েছে। তারা সবাই জ্ঞানী-গুণী মানুষ, আমার থেকে অনেক বেশি লেখাপড়া জানেন, তারা যেভাবে এটা করেছেন সেভাবেই সবকিছু হয়েছে।”
মন্ত্রী রাশার খাতাটা দেখিয়ে বললেন, “এখন আমার কাছে একটা খাতা এসেছে, অলিম্পিয়াডের নিয়ম-কানুন মানে নাই দেখে এই খাতাটা বাতিল হয়েছে। ঠিকই আছে–আমার কিছু বলার নাই। তবে যে জিনিসটা খুবই ইন্টারেস্টিং সেটা হচ্ছে, এইটা যার খাতা সেই মেয়েটা সবচেয়ে বেশি মার্কস পেয়েছে। সবার চেয়ে বেশি।”
প্যান্ডেলের নিচে বসে থাকা সবাই বিস্ময়ের মতো শব্দ করল!
মন্ত্রী বললেন, “সায়েন্স অলিম্পিয়াড কমিটি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমি সেটাকে পুরোপুরি সম্মান দেখাচ্ছি, যে খাতাটা বাতিল সেটা বাতিলই থাকুক। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে এই মেয়েটাকে একটা পুরস্কার দিতে চাই। আপনারা কী বলেন?”
সামনে বসে থাকা হাজার খানেক ছেলেমেয়ে আর তাদের বাবা-মা চিৎকার করে বলল, “পুরস্কার! পুরস্কার!”
মন্ত্রী বলল, “তাহলে মা তুমি আসো!” মন্ত্রী খাতাটা দেখে রাশার নামটা পড়লেন।
প্যান্ডেলের নিচে বসে থাকা হাজার খানেক ছেলেমেয়ে, তাদের বাবা-মা আর শিক্ষকেরা নিশ্বাস বন্ধ করে মানুষটিকে দেখার জন্যে বসে রইল।
রাশা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে বসে রইল, তার চোখে পানি এসে গিয়েছে, সে সাবধানে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ দুটো মুছে নিল। তারপর সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। তার পাশে বসে থাকা ঝকঝকে চেহারার মেয়েটির মনে হলো একটা হার্ট অ্যাটাক হলো, চিৎকার করে বলল, “তুমি?”