.
রাশা এবারেও কোনো কথা বলল না, তাকিয়ে কল্পনা করার চেষ্টা করল, দুটো তালগাছ হলে সেটা কেমন দেখাত। ধীরে ধীরে রাস্তাটা আরো সরু হয়ে গেলে, একেবারে শেষে একটা বাঁশের সাঁকো পার হতে হলো। আম্মু তার স্যান্ডেল দুটো খুলে হাতে নিয়ে নিলেন, রাশা জুতো পরেই পার হয়ে গেল। কিছু ঝোঁপঝাড় পার হয়ে একটা বিবর্ণ টিনের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আম্মু বললেন, “এইটা তোর নানু বাড়ি।”
রাশ চোখ তুলে তাকাল। টেলিভিশনে মাঝে মাঝে যখন কোনো গ্রাম গঞ্জের খবর দেখায় তখন সে খবরের মাঝে এরকম বাড়ির ছবি দেখেছে, এই প্রথমবার সত্যি সত্যি দেখল। বাইরের টিনের ঘরের পাশ দিয়ে আম্মু ভেতরে ঢুকলেন, মাঝখানে খালি একটা উঠান, তার দুই পাশে দুইটা ঘর। একটা ঘরের টিনের ছাদ অন্যটার খড়ের ছাউনি। মাঝখানের উঠানটুকু বড় আর তকতকে পরিষ্কার। কোথাও কোনো জনমানুষ নেই, শুধু একটা মুরগি তার ছানাদের নিয়ে খুঁটে খুঁটে খাচ্ছিল। তাদের দেখে মুরগিটা কঁক কঁক করে একটা সতর্ক শব্দ করল, অমনি সবগুলো ছানা ছুটে এসে মুরগির তলায় আশ্রয় নিল। তাদের দেখে যখন বুঝতে পারল কোনো বিপদ নেই তখন আবার সবগুলো আশেপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যেতে থাকে।
রিকশাওয়ালা মানুষটি তার মাথা থেকে স্যুটকেসটা উঠানে নামিয়ে রেখে গামছা দিয়ে তার মুখ-গলা মুছতে থাকে। আম্মু এদিক-সেদিক তাকিয়ে ডাকলেন, “মা।”
কেউ উত্তর দিল না। আম্মু তখন টিনের ঘরের সামনে গিয়ে দরজাটি ধাক্কা দিলেন, দরজাটি সাথে সাথে খুলে গেল। আম্মু ভেতরে ঢুকে একটু পরে বের হয়ে বললেন, “ভিতরে কেউ নাই।”
রাশা কোনো কথা বলল না। আম্মু বললেন, “আয় বাড়ির পিছনে যাই। বাড়ির পিছনে পুকুর ঘাটে আছে কিনা দেখি।”
আম্মু টিনের ঘরের পাশ দিয়ে বাড়ির পিছনের দিকে রওনা দিলেন। রাশা অপেক্ষা করবে নাকি পিছনে পিছনে যাবে ঠিক বুঝতে পারছিল না, শেষে আম্মুর পিছনে পিছনেই গেল। বাড়ির পিছনে অনেক গাছপালা, বড় বড় বাঁশঝাড়। তার নিচে শুকনো পাতা মাড়িয়ে রাশা আম্মুর পিছনে পিছনে যেতে থাকে। সামনে একটা বড় পুকুর, পুকুরের কালো পানি টলটল করছে। পুকুরের পাশে ছায়াঢাকা একটা পুকুর ঘাট। রাশা দেখল সেই পুকুরঘাটে হেলান দিয়ে গুটিশুটি মেরে একজন মহিলা বসে আছেন, মহিলা পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে আছেন তাই তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না।
আম্মু ডাকলেন, “মা।”
মহিলাটি পিছনে ঘুরে না তাকিয়ে বললেন, “কে?”
“আমি মা। আমি নীলু।”
রাশার মায়ের নাম নীলু, বহুদিন তাকে এই নামে কেউ ডাকে না। পুকুর ঘাটে বসে থাকা মহিলাটা একবারও পিছন দিকে না তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “সাথে কে?”
“আমার মেয়ে। রাশা।”
কথা বলতে বলতে আম্মু তার মায়ের পাশে দাঁড়ালেন কিন্তু তার মা একবারও মাথা ঘুরিয়ে মেয়েকে দেখার চেষ্টা করলেন না। শীতল গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “তোর পাগলি, মাথা খারাপ মায়ের কাছে কেন এসেছিস?”
আম্মু থতমত খেয়ে গেলেন, আমতা আমতা করে বললেন, “না, মানে ইয়ে আসলে-”
“এত বছর পার হয়ে গেল কখনো একবারও খবর নিলি না। এখন হঠাৎ করে একেবারে মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছিস। ব্যাপারটা কী?”
আম্মু ইতস্তুত করে বললেন, “আমি আসলে একটু দেশের বাইরে যাব অস্ট্রেলিয়াতে। রাশাকে–মানে আমার মেয়েকে কোথায় রেখে যাব ঠিক করতে পারছিলাম না। তাই ভাবলাম তোমার কাছে রেখে যাই।”
“কত দিনের জন্যে যাচ্ছিস?”
“মানে, আসলে বেশ কিছুদিন, মানে হয়েছে কী”
“আরেকজনকে বিয়ে করেছিস?”
আম্মুর মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেল, মাথা নিচু করে বললেন, “হ্যাঁ।”
“জামাই তোর মেয়েকে নিবে না?”
আম্মু কোনো কথা না বলে চুপ করে রইলেন।
“তাই মেয়েটাকে এখানে ফেলে রেখে চলে যাচ্ছিস? এর চাইতে মেয়েটার গলাটা কেটে নদীতে ভাসিয়ে দিলি না কেন? তোর মেয়ে এই গাঁও-গেরামে কিভাবে থাকবে?”
আম্মু বললেন, “আসলে মা তুমি ঠিক বুঝতে পারছ না। আমার কোনো উপায় ছিল না–”
“আমার মাথাটা আউলাঝাউলা সেই কথা সত্যি। আমি পাগল মানুষ সেইটাও সত্যি কিন্তু আমি তো বেকুব না নীলু! তুই তোর মেয়ের এত বড় সর্বনাশ কেন করতে যাচ্ছিস?”
“আমি সর্বনাশ করতে যাচ্ছি না মা–আমি একটু গুছিয়ে নিয়ে–”
রাশা দেখল তার নানি হঠাৎ করে হাত তুলে তার আম্মুকে থামিয়ে দিলেন, বললেন, “আমার নাতনি কই? আমি কপাল পোড়া মেয়েটাকে একবার দেখি।”
তার নানি তখন ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে পিছন দিকে তাকালেন, এই প্রথম রাশা তার মাথা খারাপ পাগলি নানিকে দেখতে পেল। তার নানি দেখতে কেমন হবেন সেটা সে গত কয়েক দিনে অনেকবার কল্পনা করেছে। সাদা শণের মতো রুক্ষ চুল, তোবড়ানো গাল, মুখে বয়সের বলিরেখা, কোটরাগত লাল ক্রুদ্ধ চোখ—-কিন্তু সে অবাক হয়ে দেখল তার নানির চেহারায় বয়সের কোনো ছাপ নেই, দেখে মনে হয় তার মায়ের বড় বোন। চুলে অল্প একটু পাক ধরেছে, রোদে পোড়া চেহারা, তার মাঝে শুধু জ্বলজ্বলে তীব্র এক জোড়া চোখ। রাশার মনে হলো সেই চোখ দিয়ে তার নানি তাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে ফেললেন।
নানি কিছুক্ষণ রাশার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন, তারপর হাত নেড়ে ডাকলেন, বললেন, “আয়। কাছে আয়।”
রাশা ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেল, নানি হাত দিয়ে তাকে ধরলেন, তারপর কাছে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “আমি জানতাম তুই আসবি। তাই আমি সেজেগুজে তোর জন্যে অপেক্ষা করছি।”