খিটখিটে মানুষটা দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, “বেয়াদব মেয়ে।” কিছুক্ষণ হিংস্র চোখে সে রাশার দিকে তাকিয়ে রইল তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “তুমি আমাকে চেনো না! আমি তোমাকে ভয় দেখানোর জন্যে কোনো কথা বলি নাই, আমি সত্যি সত্যি তোমার খাতা ক্যান্সেল করব। এই দেখো—”
মানুষটি টেবিল থেকে একটা লাল মার্কার হাতে তুলে নেয়, তখন মিমি নামের মেয়েটা ছুটে এসে রাশার খাতাটা আড়াল করার চেষ্টা করল, কাতর গলায় বলল, “প্লিজ স্যার। প্লিজ! ওর খাতাটা ক্যান্সেল করবেন না–আমাকে পাঁচটা মিনিট সময় দেন আমি ওর স্কুলের নাম নিয়ে আসছি! প্লিজ!”
খিটখিটে মানুষটি প্রায় ধাক্কা দিয়ে মিমিকে সরিয়ে দিয়ে রাশার খাতার ওপর লাল কালিতে বড় বড় করে ইংরেজিতে লিখল ক্যান্সেল! তারপর খাতাটা ছুঁড়ে দিয়ে রাশার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি এবারে যেতে পারো। যদি আমাকে জিজ্ঞেস করো তাহলে বলব, ইচ্ছে হলে জাহান্নামেও যেতে পারো।”
রাশা ঘর থেকে শান্ত মুখে বের হয়ে এলো, সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় তার চোখ দিয়ে পানি বের হতে থাকে। কাঁদবে না, সে কিছুতেই কাদবে না প্রতিজ্ঞা করেও সে নিচে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ঝরঝর করে কাঁদতে থাকে। বিল্ডিংয়ের একটা বড় পিলারের আড়ালে দাঁড়িয়ে সে অনেক কষ্টে নিজের কান্না থামানোর চেষ্টা করল, কিন্তু কিছুতেই থামাতে পারল না, সে দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল, কেউ দেখে ফেললে সেটা ভারি লজ্জার ব্যাপার হবে।
রাশা অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করল, তারপর বের হয়ে এলো। এখন আর এখানে থাকার কোনো অর্থ নেই। সত্যি কথা বলতে কী যখন পুরস্কার দেয়া হবে তখন যখন ফাস্ট প্রাইজ দেয়া হবে তখন মনে হয় দুঃখে তার বুকটা একেবারে ফেটে যাবে। সে তখন কেমন করে সেই দৃশ্য সহ্য করবে? রাশা টের পায় তার ভেতরে ভয়ঙ্কর একধরনের রাগ ফুঁসে উঠছে, অনেক কষ্ট করে সে নিজেকে শান্ত করল।
হেডস্যার বলেছেন এখানে থাকতে, পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের শেষে তাকে এখান থেকে নিয়ে যাবেন। তাই তাকে এখানে থাকতেই হবে। একটা কাজ করা যায়, সে এখন এখান থেকে বের হয়ে যাবে, যখন পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান শেষ হবে তখন সে ফিরে আসবে। অনুষ্ঠান শেষ হবে বিকেল পাঁচটায়, ফিরে আসবে তারপর।
রাশা হেঁটে হেঁটে গেট খুলে বের হয়ে গেল। বাইরে ব্যস্ত রাস্তা, বড় বড় বাস-ট্রাক গাড়ি যাচ্ছে। রাশা ফুটপাথ ধরে হাঁটতে থাকে, ফুটপাথে নানারকম দোকানপাট। একটা বড় ওভারব্রিজ, ওভারব্রিজের নিচে ছোট একটা খুপচিতে একটা আস্ত পরিবার থাকে। ছোট একটা বাচ্চা হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছে। চার-পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা রাস্তার কাছে দাঁড়িয়ে আছে, তার নাক ঘষে বড় বড় বাস যাচ্ছে, বাচ্চাটির কোনো ভয়ডর নেই। রাশা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল, তারপর আবার হাঁটতে শুরু করল। ফুটপাথে একজন নানা রকম বই বিক্রি করছে, রাশা খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বইগুলো দেখল। একটু পরে সে আবিষ্কার করল আসলে সে শুধু তাকিয়ে আছে, কিছু দেখছে না। তার এত অস্থির লাগছে যে সে কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। মনে হচ্ছে লাফিয়ে একটা চলন্ত বাসের নিচে চাপা পড়ে যায়।
“না, আমি পাগলামো করব না।” রাশ নিজেকে বোঝাল, “আমি যেটা করেছি, ঠিকই করেছি। আমি বলেছিলাম আমি রাজাকারের নাম লিখব না, আমি নাম লিখি নাই। যে রাজাকার আমার নানাকে খুন করেছে, আমি মরে গেলেও তার নাম লিখব না। আমার নানা ছিলেন মুক্তিযাদ্ধা, আমি নানার সম্মানের জন্যে ফাইট করেছি। কেউ এই ফাইটের কথা জানবে না। না জানলে নাই–আমি তো জানব!” রাশা বিড়বিড় করে বলল, “আমি জানব। আমি জানব। আমি জানব।”
রাশা ইতস্তত হাঁটে, একটা বাসস্ট্যান্ডে অনেক মানুষ বসে ছিলো একটা বাস আসতেই সবাই বাসে উঠে যেতেই বাসস্ট্যান্ড খালি হয়ে গেল। রাশা তখন চুপচাপ বাসস্ট্যান্ডে বসে থাকে। বেঞ্চের অন্যপাশে একটা পাগল বসে আছে, তার খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখগুলো লাল, দাঁতগুলো হলুদ। পাগল মানুষটা রাশার দিকে তাকিয়ে এমনভাবে হাসল, যেন সে কত দিনের পরিচিত। রাশা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে রাস্তার দিক তাকিয়ে থাকে।
পাঁচটা বাজার পরও রাশা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল, তারপর সে হেঁটে গণিত অলিম্পিয়াডের মাঠের দিকে রওনা দিল। এতক্ষণে নিশ্চয়ই পুরস্কার দেয়া হয়ে গেছে। তার যে ফার্স্ট প্রাইজটা পাওয়ার কথা ছিল সেটা অন্য একজন নিয়ে নিচ্ছে তাকে নিশ্চয়ই এখন আর সেই দৃশ্যটা দেখতে হবে না।
সায়েন্স অলিম্পিয়াডের মাঠের কাছে এসে রাশা গেট খুলে ভেতরে ঢুকল, সে ভেবেছিল দেখবে পুরো মাঠ ফাঁকা, কিন্তু অবাক হয়ে দেখল প্যান্ডেল বোঝাই মানুষ। রাশা আরেকটু এগিয়ে গেল তখন দেখতে পেল একটা মানুষ বক্তৃতা দিতে উঠেছে। নিশ্চয়ই শেষ বক্তৃতা, রাশা নিজেকে বুঝিয়ে আরেকটু এগিয়ে গেল। অনেক মানুষ, বসার জায়গা বলতে গেলে নেই, একটু সামনে একটা চেয়ার ফাঁকা, রাশা সেখানে গিয়ে বসল। পাশে তাকিয়ে দেখে হোস্টেলে প্রথম দিন দেখতে পাওয়া ঝকঝকে চেহারার মেয়েটি, যে মেয়েটি সন্দেহ করেছিল যে সে বড় কোনো মানুষকে দিয়ে অঙ্কগুলো করিয়ে পাঠিয়েছে। রাশা অস্বস্তিবোধ করতে থাকে, কিন্তু কিছু করার নেই। মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, “তুমি এখন এসেছ?”