তারপর আম্মু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। রাশা তার আম্মুর দিকে তাকিয়ে থাকলেও তাকে দেখছিল না! সে ইন্টারনেটে দেখা আত্মহত্যার উপায়গুলোর কথা ভাবছিল। অনেকগুলো উপায়ের কথা সেখানে লেখা ছিল কিন্তু সে একটাও মনে করতে পারছিল না।
একটাও না। তাতে অবশ্যি কিছু আসে যায় না, যখন সময় হবে তখন মনে করতে পারলেই হবে। তখন নিশ্চয়ই মনে হয়ে যাবে।
০২. একটি গহীন গ্রাম
রাস্তার পাশে রিকশা-ভ্যানটা থামিয়ে রিকশাওয়ালা নেমে গামছা দিয়ে মুখ মুছে বলল, “আর সামনে যাবে না। বাকিটা হেঁটে যেতে হবে।”
আম্মু অন্যমনস্কভাবে বললেন, “হেঁটে যেতে হবে?”
“জে।” মাঝবয়সী রিকশাওয়ালা সামনের কাঁচা রাস্তাটা দেখিয়ে বলল, “বর্ষার সময় সব পানিতে ডুবে যায় তখন নৌকা করে যাওয়া যায়।”
আম্মু বললেন, “ও।” বহুদিন পর আম্মু এখানে এসেছেন। আজকাল যেখানেই কিছুদিন পরে যান গিয়ে জায়গাটা চিনতে পারেন না। ফাঁকা একটা জায়গা বাড়িঘরে ঘিঞ্জি হয়ে যায়। এই এলাকাটার কোনো পরিবর্তন হয়নি, সেই ছোট থাকতে যে রকম দেখেছিলেন এখনো সে রকমই আছে।
রাশ রিকশা-ভ্যানে পা তুলে বসেছিল, এবারে নেমে পড়ে। গতরাতে তারা রওনা দিয়েছে, সারারাত ট্রেনে কেটেছে, সকালে নেমে বাস ধরেছে। বাসের পর স্কুটার তারপর রিকশা-ভ্যান। বাকিটা হেঁটে যেতে হবে। রাশা অন্যমনস্কভাবে চারপাশে তাকাল কিন্তু খুব ভালো করে কিছু দেখল বলে মনে হয় না। একটু আগে জলার ধারে একটা গাছের ওপর একটা মাছরাঙা পাখি বসেছিল, এত সুন্দর রঙিন পাখি সে জীবনে কখনোই দেখেনি, কিন্তু তারপরেও পাখিটা দেখে তার ভেতরে কোনো আনন্দ হলো না। আসলে তার ভেতরটা এখন মনে হয় মরে গেছে, আনন্দ বা দুঃখ কোনো অনুভূতিই হচ্ছে না। মনে হচ্ছে চারপাশে যেটা ঘটছে তার পুরোটাই একটা দুঃস্বপ্ন। মনে হচ্ছে এক্ষুণি তার ঘুম ভেঙে যাবে আর ঘুম থেকে উঠে দেখবে সে তার ঘরে কম্পিউটারের সামনে বসে আছে। রাশা জানে এটা দুঃস্বপ্ন নয় এটা সত্যি, তাই সম্পূর্ণ অপরিচিত একধরনের দুঃখ, হতাশা আর আতঙ্কে বুকের ভেতরটা অসাড় হয়ে আছে।
আম্মু রিকশা-ভ্যান থেকে নেমে রাশাকে বললেন, “নেমে আয় মা। হেঁটে যেতে হবে। পারবি না?”
রাশা কোনো কথা না বলে মাথা নেড়ে জানাল যে সে পারবে। রিকশাওয়ালা ভ্যান থেকে আম্মুর ছোট ব্যাগ আর রাশার বড় স্যুটকেসটা নামাল। এই স্যুটকেসের মাঝে তার বাকি জীবনটা কাটানোর জন্যে যা যা লাগবে সেটা আঁটানো হয়েছে। আম্মু বারবার বলেছেন, “যা যা লাগবে সব নিয়ে নে মা। আর তো নিতে পারবি না।” রাশা তখন খুব চিন্তা ভাবনা করেনি। অনেকটা অন্যমনস্কভাবে হাতের কাছে যা পেয়েছে স্যুটকেসে ভরেছে। সে তখনো বিশ্বাস করেনি যে সত্যি সত্যি এটা ঘটছে। স্যুটকেসের মাঝে তার কিছু জামা-কাপড় আছে, কিছু বই। তার কম্পিউটারটা আনতে পারলে হতো, কিন্তু আম্মু বলেছেন তারা যেখানে যাচ্ছে তার আশেপাশে কোথাও ইলেকট্রিসিটি নেই। তা ছাড়া এত বড় একটা কম্পিউটার, সেটা আনবে কেমন করে? এই স্যুটকেসটা আনতেই কত ঝামেলা হয়েছে।
রাশা রিকশা-ভ্যান থেকে টেনে স্যুটকেসটা নামাল। নিচে চাকা লাগানো আছে, রাস্তা ভালো হলে টেনে নেয়া যেত। কাদামাটির এই কাঁচা রাস্তায় কেমন করে নেবে সে জানে না।
আম্মু রিকশাওয়ালাকে বললেন, “আমি কিন্তু আজকেই ফিরে যাব। মনে আছে তো?”
মানুষটা মাথা নাড়ল, বলল, “জে মনে আছে।”
আম্মু রাশার স্যুটকেসটা দেখিয়ে বললেন, “এই সুটকেসটা পৌঁছে দিতে হবে। কাউকে পাওয়া যাবে?”
মানুষটা বলল, “আমি পৌঁছে দেব।”
“রিকশা-ভ্যান? কেউ নিয়ে যাবে না তো?
“এইখানে কারো বাড়িতে রেখে যাব। কেউ নিবে না। এই গাঁও গেরামে সবাই সবাইরে চিনে।”
কিছুক্ষণের মাঝেই তিনজনের এই ছোট দলটা এগিয়ে যেতে থাকে, সামনে রাখার স্যুটকেস মাথায় রিকশাওয়ালা, তার পিছনে আম্মু সবার পিছনে রাশা। আম্মু মাঝে মাঝে থেমে রাশার সাথে একটা-দুইটা কথা বলার চেষ্টা করেছেন কিন্তু রাশা হুঁ-হ্যাঁ ছাড়া আর কিছু বলেনি, তাই আলাপ বেশি দূর এগুতে পারেনি।
গ্রামের কাঁচা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে রাশা দুই পাশে তাকাচ্ছিল। যদি স্কুলের সব ছেলেমেয়েকে নিয়ে এখানে পিকনিক করতে আসত তাহলে এতক্ষণে চারপাশের ক্ষেত, মাঠ, খাল, গাছপালা, গরু, ছাগল, পাখি এসব দেখে সবাই উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠত। সবাই মিলে মাঠে দৌগাদৌড়ি করত, খালের পানিতে লাফঝাঁপ দিত, গরুর বাছুরকে ধরে ছবি তুলত। এখন সবকিছুকে মনে হচ্ছে পুরোপুরি অর্থহীন। মেঠোপথে মানুষজন খুব বেশি নেই, হঠাৎ হঠাৎ এক-দুইজনকে দেখা যায়। তারা তখন কৌতূহলী হয়ে তাদের দিকে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকায়। রাশাও একবার ঘুরে একটা মেয়ের দিকে তাকাল, আট-নয় বছরের শুকনো লিকলিকে একটা মেয়ে, কুচকুচে কালো গায়ের রং মাথায় লাল চুল রুক্ষ–বাতাসে উড়ছে, খালি গা, শুধু একটা বেড় প্যান্ট পরে আছে। হাতে একটা চিকন বাঁশেল কঞ্চি, সেটা হাতে নিয়ে উদাস মুখে সে একটা ক্রুদ্ধ চোখে দেখে রাশার ভয়ে বুক কেঁপে উঠে, কিন্তু এই লিকলিকে ছোট মেয়েটির বুকে কোনো ভয়ডর নেই, রাশা। আবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। একটা বড় বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আম্মু বললেন, ঐ যে তালগাছটা দেখছিস সেটা হচ্ছে তোর নানু বাড়ি। রাশা কোনো কথা বলল না। আম্মু বললেন, আগে দুইটা তাল গাছ ছিল, একটা বাজ পড়ে পুড়ে গেছে।