আব্বু কথা বলে যেতে থাকলেন, কানাডা যে কত ভালো একটা দেশ আর বাংলাদেশ যে কত খারাপ একটা দেশ আন্তু সেটা ঘুরে-ফিরে অনেকবার বললেন। রাশা শুনতে শুনতে অন্যমনস্ক হয়ে গেল, একসময় লক্ষ করল অন্য পাশে আব্বু টেলিফোন রেখে দিয়েছেন।
রাশা কান থেকে টেলিফোনটা সরিয়ে আম্মুর দিকে তাকাল। আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “কী বলেছে?” রাশা মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, “বলেছেন পারবেন না।”
“পারবে না? বদমাইশটা পারবে না? বাচ্চা জন্ম দেবার সময় মনে ছিল না?”
রাশা কোনো কথা বলল না! আম্মু হঠাৎ অপ্রকৃতিস্থর মতো চিৎকার করে উঠলেন, “শুধু তোর বদমাইশ বাপ ফুর্তি করবে? কানাডা ইউরোপ আমেরিকা করবে? আর আমি বাংলাদেশের চিপা গলিতে বসে বসে আঙুল চুষব? আমার মেয়েকে পালব? আমার জীবনে কোনো সাধ-আহ্লাদ থাকবে না?”
রাশা কী বলবে বুঝতে পারল না। কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, “তুমি কী চাও আম্মু? কী করতে চাও?”
“আমি নূতন করে লাইফ শুরু করতে চাই।”
“করে আম্মু। তুমি করো।”
“করব?” আম্মু চিৎকার করে বললেন, “কিভাবে করব? তুই আমার গলার মাঝে ঝুলে থাকলে কিভাবে শুরু করব? এই রকম ধাড়ি একটা মেয়ে নিয়ে লাইফ শুরু করা যায়? যায় শুরু করা?”
রাশা আস্তে আস্তে প্রায় শোনা যায় না এভাবে বলল, “যাবে আম্মু। শুরু করা যাবে। আমি বলছি শুরু করা যাবে।”
সেদিন রাতে রাশা ঘুমাতে গেল অনেক দেরি করে। ঘুমানোর আগে পৃথিবীতে মানুষেরা কেমন করে আত্মহত্যা করে সেটা সে ইন্টারনেট থেকে খুঁজে বের করল। তারপর অনেক দিন পর সে শান্তিতে ঘুমাতে গেল।
পরের দুই সপ্তাহ আম্মু তাকে কিছুই বললেন না, কিন্তু রাশা বুঝতে পারল কিছু একটা ঘটছে। কী ঘটছে সে জানে না কি সেটাও অনুমান করতে পারে। দুই সপ্তাহ পর গভীর রাতে আম্মু তার ঘরে এলেন, তার বিছানায় বসে নরম গলায় বললেন, “রাশা, মা। তোর সাথে একটু কথা আছে।”
আম্মুর গলার স্বরে কিছু একটা ছিল যেটা শুনে রাশা হঠাৎ করে বুঝে গেল খুব বড় একটা কিছু ঘটে গেছে। সে কম্পিউটারের কি-বোর্ড থেকে হাত সরিয়ে বলল, “বলো আম্মু।”
“আমি অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছি।”
রাশা কথাটা ঠিক বুঝতে পারল না, খানিকক্ষণ অবাক হয়ে আম্মুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “কোথায় চলে যাচ্ছ?”
“অস্ট্রেলিয়া।” আম্মু রাশার দৃষ্টি থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বললেন, “আমি জানি তুই আমার ওপর নিশ্চয়ই খুব রাগ হবি, হওয়ারই কথা। কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না।”
রাশা আবার বিড়বিড় করে বলল, “অস্ট্রেলিয়া?”
“হ্যাঁ। বুঝতেই পারছিস, আমাকে অস্ট্রেলিয়া কে নিবে? সেই জন্যে আমার একজন অস্ট্রেলিয়ান সিটিজেনকে বিয়ে করতে হয়েছে। মানুষটা ভালো, কিন্তু
রাশ আবার বিড়বিড় করে কী বলছে না বুঝেই বলল, “অস্ট্রেলিয়া!”
“মানুষটা ভালো। আমাকে খুব লাইক করে কিন্তু কোনো বাড়তি ঝামেলা চায় না। আগের পক্ষের বাচ্চা নিতে রাজি না।”
রাশা অবাক হয়ে তার আম্মুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। আম্মু অন্যদিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “আমার বয়স হয়েছে। আমাকে কে বিয়ে করবে বল? এই মানুষটা রাজি হয়েছে, কিন্তু শর্ত একটা। তোকে রেখে যেতে হবে।”
রাশার পৃথিবীটা চোখের পলকে ধ্বংস হয়ে গেল। তার খুব ইচ্ছে হলো বলে, “প্লিজ আম্মু তুমি আমাকে রেখে চলে যেয়ো না।” কিন্তু সে বলল না। জিজ্ঞেস করল, “আমাকে কোথায় রেখে যাবে?”
“তোর বড় খালাকে বলেছিলাম, রাজি হলো না। এখন টেলিফোন করলে লাইন কেটে দেয়।”
রাশা তার আম্মুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। আম্মু বিড়বিড় করে বললেন, “মেয়েদের হোস্টেল আছে শুনেছিলাম। এত এক্সপেনসিভ যে আমার পক্ষে কুলানো সম্ভব না। তোর বাপ সাহায্য করলে একটা কথা ছিল। সে তো কিছু করবে না।”
রাশা নিজের ভেতরে কেমন যেন আতঙ্ক অনুভব করে। আম্মু খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “অনেক চিন্তা করে দেখলাম তোকে তোর নানির কাছে রেখে যাওয়াই সবচেয়ে ভালো। নানি দেখে শুনে রাখবে। আদর-যত্ন করবে।”
রাশা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না, মুখ হাঁ করে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। আম্মু বললেন, “তোর নানি ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না।”
রাশ খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, “কিন্তু আম্মু, নানি তো পাগল।
আম্মু জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন, “একটু মাথার দোষ আছে, সেটা কার নাই? এত কম বয়সে এত বড় ধাক্কা খেলে সবারই মাথা খারাপ হয়ে যেত।”
“তুমি কোনোদিন নানি বাড়ি যাও নাই। কোনোদিন আমাকে যেতে দাও নাই। তুমি বলেছ নানি বদ্ধ উন্মাদ, বেঁধে রাখা দরকার। তুমি বলেছ”
আম্মু বললেন, “কিন্তু আর কোথায় রেখে যাব? শুনেছি তোর নানি এখন অনেক ভালো। সম্পত্তি দেখেশুনে রাখছে না? পাগল হলে কি পারত?”
“আমার স্কুল?”
আম্মুকে দেখে মনে হলো, কথাটা শুনে যেন খুব অবাক হয়ে গেছেন। খানিকক্ষণ আমতা আমতা করে বললেন, “ওখানে নিশ্চয়ই স্কুল আছে। সেই স্কুলে পড়বি। লেখাপড়া কি আর স্কুল দিয়ে হয়? লেখাপড়া তো নিজের কাছে?”
রাশা দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে রইল। আম্মু ফিসফিস করে বললেন, “আমাকে একটু সময় দে মা। আমি অস্ট্রেলিয়া গিয়ে গুছিয়ে নিই, তারপর তোকে নিয়ে যাব। আই প্রমিজ।”
রাশা কোনো কথা বলল না। আম্মু বললেন, “তুই আমার ওপর রাগ করে থাকিস না মা। আমার কোনো উপায় ছিল না। বিশ্বাস করো, আমার কোনো উপায় ছিল না। একটা মা কি কখনো তার বাচ্চাকে ফেলে রেখে যেতে পারে? পারে না?”