“কয়দিন থেকেই ভাবছি তোর সাথে একটা জিনিস নিয়ে কথা বলি—”
রাশার বুকটা ছাৎ করে উঠল, সে অনেক কষ্ট করে মুখটা শান্ত রেখে বলল, “বলো আম্মু।”
আম্মু বললেন, “তুই তো এখন আর ছোট মেয়ে না। তুই তো বড় হয়েছিস। ঠিক কিনা?”
রাশা কী বলবে বুঝতে না পেরে মাথা নাড়ল। আম্মু বললেন, “তোর বাপ যে আমার ওপর তোর পুরো দায়িত্ব দিয়ে চলে গেল, সেটা ঠিক হয়েছে?”
রাশা দুর্বলভাবে মাথা নেড়ে বোঝানোর চেষ্টা করল যে কাজটা ঠিক হয়নি। আম্মু মুখটা কঠিন করে বললেন, “আমি তো অনেক দিন তোর দায়িত্ব নেবার চেষ্টা করলাম, এখন তোর বাপ কিছুদিন তোর দায়িত্ব নিক।”
রাশা শুকনো মুখে তার আম্মুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। আম্মু রাশার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে নেল পালিশ দিয়ে রং করা নিজের হাতের নখগুলো দেখতে দেখতে বললেন, “তুই তোর বাপরে ফোন করবি। ফোন করে বলবি তোকে যেন নিয়ে যায়।”
রাশা কী বলবে বুঝতে পারল না। কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, “আব্বু আমাকে নিয়ে যাবে?”
আম্মু কঠিন গলায় বললেন, “কেন নিবে না? তুই কি আমার একার বাচ্চা?”
রাশা কে গিলে বলল, “যদি নিতে না চায়?”
আম্মুর চোখগুলো ছোট হয়ে গেল, সেই ভাবে রাশার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “যদি নিতে না চায় তাহলে তার অন্যব্যবস্থা করে দিতে হবে।”
“অ-অন্য ব্যবস্থা? অন্য কী ব্যবস্থা?”
আম্মু হিংস্র গলায় বললেন, “আমি সেটা জানি না। তোর বাপকে বলিস বের করতে সে কী ব্যবস্থা নিতে চায়।”
আম্মু আরও কিছুক্ষণ বসে থাকলেন, বিড়বিড় করে আরো নানা রকম কথা বললেন, রাশা কিছু শুনতে পেল কিছু শুনতে পেল না। তার মনে হতে লাগল, চারপাশের সবকিছু যেন ভেঙে ভেঙে পড়ে যাচ্ছে। মনে হতে লাগল, ঘরের সব বাতি নিভে অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। মনে হতে লাগল, সে বুঝি বিশাল একটা মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে আর আকাশ কালো করে ঝড় উঠেছে, হু হু করে বাতাস বইছে, আর কালো মেঘ এসে চারদিক ঢেকে ফেলছে।
রাশা সারারাত ঘুমাতে পারল না, বিছানায় ছটফট ছটফট করে কাটিয়ে দিল।
.
দুইদিন পর আবার রাত্রিবেলা আম্মু হাজির হলেন। হাতে একটা টেলিফোন। টেলিফোনটা রাশার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “নে টেলিফোন কর।”
কাকে টেলিফোন করার কথা বলছেন সেটা বুঝতে রাশার একটুও দেরি হলো না। তবু সে জিজ্ঞেস করল, “কাকে?”
“তোর বাপকে।”
“আব্বুকে? এখন?”
“হ্যাঁ।”
রাশা কেমন যেন অসহায় বোধ করে। সে দুর্বল গলায় বলে, “আম্মু, প্লিজ আম্মু-”
“ঘ্যান ঘ্যান করবি না। টেলিফোন করো।”
“করে কী বলব?”
আম্মু মুখ শক্ত করে বললেন, “বলবি আমাকে নিয়ে যাও। না হলে আমার একটা ব্যবস্থা করো।”
“আম্মু–” রাশা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “তুমি তো জানো আম্মু-”
“আমি কিছু জানি না। আমি কিছু জানতেও চাই না।” আম্মু টেলিফোনটা রাশার মুখের কাছে ধরলেন। বললেন, “টেলিফোন করো।”
রাশা কিছুক্ষণ আম্মুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তুমি সত্যিই আমাকে বিদায় করে দিতে চাও আম্মু?”
আম্মু হঠাৎ কেমন যেন খেপে উঠলেন, বললেন, “ঢং করবি না। টেলিফোন করো।”
“টেলিফোন নাম্বার?”
আম্মু নিজেই ডায়াল করলেন তারপর কানে লাগিয়ে কিছু একটা শুনলেন তারপর টেলিফোনটা রাশার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “রিং হচ্ছে।”
রাশ টেলিফোনটা হাতে নিল। কানে লাগিয়ে শুনল একটু পরপর রিং হচ্ছে। বেশ কয়েকটা রিং হবার পর খুট করে একটা শব্দ হলো তারপর একটা ভারী গলার আওয়াজ শোনা গেল, “হ্যালো।”
অনেক দিন পর শুনছে ভারপরেও রাশা তার আব্বুর গলার স্বরটা চিনতে পারল। রাশা বলল, “আব্বু আমি রাশা।”
ও পাশ থেকে আব্বু বললেন, “এক্সকিউজ মি?”
রাশা আবার বলল, “আব্বু, আমি রাশা। বাংলাদেশ থেকে।”
আব্বু এবারে চিনতে পারলেন এবং মনে হলো একটু থিতিয়ে গেলেন, আমতা আমতা করে বললেন, “রাশা, কী খবর?”
“আম্মু বলেছেন তোমাকে ফোন করতে।”
“কেন? কী হয়েছে?”
রাশা ঠিক কিভাবে বলবে বুঝতে পারছিল না। একটু ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত এক নিশ্বাসে বলেই ফেলল, “আম্মু বলেছেন আমাকে নিয়ে যেতে।”
“নিয়ে যেতে?” আব্বু শব্দ করে একটু হাসলেন, তারপর বললেন, “নিয়ে যাওয়া এতো সোজা নাকি? ইমিগ্রেশান লাগে, ভিসা লাগে, প্লেনের টিকিট লাগে! এগুলো কি গাছে ধরে নাকি?”
অপমানে রাশার কানের ডগা পর্যন্ত লাল হয়ে গেল, তারপরেও দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আম্মু বলেছেন যে, আমার দায়িত্ব আম্মু আর নিতে পারবেন না। এখন তোমাকে নিতে হবে।”
“আমাকে?” আলু আবার শব্দ করে হাসলেন, যেন খুব মজার কথা বলেছে। “আমি কেমন করে তোর দায়িত্ব নিব? আমার নিজেরই ঠিক নাই। ইমিগ্রেশন হয়েছে তাই কোনোভাবে ওয়েলফেয়ারে আছি। ভদ্রলোকের দেশ তাই রক্ষা।” তা না হলে তো না খেয়ে থাকতে হতো।”
আম্মু শীতল চোখে তাকিয়ে ছিলেন, রাশা আম্মুর দৃষ্টি থেকে চোখ সরিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, “আব্বু তোমার কিছু একটা করতে হবে। প্লিজ।”
“আমি কী করব? দুনিয়ার আরেক মাথা থেকে আমার কিছু করার আছে নাকি? বললেই হবে দায়িত্ব নিতে পারবে না? তোর আম্মুকে বল পাগলামি না করতে।”
রাশা কিছু বলল না। আব্বু বললেন, “তোর আম্মু সবসময়ই এরকম। দায়িত্বজ্ঞান বলে কিছু নাই। যত্তোসব।”
রাশা এবারেও কিছু বলল না। আব্বু হঠাৎ সুর পাল্টে বললেন, “কয়দিন আগে তোকে একটা ভিউকার্ড পাঠিয়েছিলাম। পেয়েছিস? নায়েগ্রা ফলসের ভিউকার্ড। নায়েগ্রা ফলসটা খুবই ইন্টারেস্টিং–অর্ধেকটা আমেরিকাতে অন্য অর্ধেক কানাডাতে। আমরা কানাডার সাইডে গিয়েছিলাম। না দেখলে বিশ্বাস করবি না–”