রাশার কেমন যেন ভয় ভয় লাগতে থাকে। কেন যেন তার মনে হতে থাকে তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে–আম্মু কিছুই বলেননি, কিন্তু রাশা পরিষ্কার বুঝতে পারল আম্মু কী বলতে চাইছেন। তার আব্বু একজনকে বিয়ে করে নূতন করে ঘর-সংসার শুরু করেছেন। তার আম্মু রাশার জন্যে সেটা করতে পারছেন না।
যতই দিন যেতে থাকে রাশার সন্দেহটা ততই পাকা হতে থাকে। আম্মু অফিসে যাবার সময় একটু বেশি সাজগোজ করে যেতে লাগলেন, অফিস থেকে ফিরে আসতে লাগলেন একটু দেরি করে। প্রায়সময়েই রাশাকে খাবার টেবিলে বসে একা একা একটা গল্পের বই পড়ে খেতে হয়। সে পড়াশোনায় ভালো ছিল কিন্তু এখন পড়াশোনায় মন দিতে পারে না। তার সবচেয়ে প্রিয় বিষয় হচ্ছে গণিত, সেই গণিতের একটা পরীক্ষায় সোজা সোজা দুইটা অঙ্ক ভুল করে ফেলল। ক্লাশে খাতা দেবার সময় তাদের গণিতের জাহানারা ম্যাডাম বললেন, “রাশা, ক্লাসের শেষে তুমি আমার সাথে দেখা করবে।”
রাশা ক্লাসের শেষে ম্যাডামের সাথে দেখা করতে গেল, সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। ম্যাডাম বললেন, “রাশা, তোমার কী হয়েছে?”
রাশা বলল, “কিছু হয় নাই ম্যাডাম।”
“নিশ্চয়ই হয়েছে। আমি লক্ষ করছি তোমার লেখাপড়ায় মন নাই। তুমি গণিতে এত ভালো ছিলে আর পরীক্ষায় সোজা সোজা দুইটা অঙ্ক ভুল করলে?”
রাশা কথা বলল না। ম্যাডাম বললেন, “শুধু গণিতে না, বাংলা পরীক্ষাতেও নাকি খারাপ করেছ। ক্লাসে কথাবার্তা বলো না, চুপ করে বসে থাকো। কী হয়েছে?”
রাশা এবারেও কথা বলল না, শুধু তার চোখে পানি চলে এলো। পানিটা লুকানোর জন্যে সে মাথা আরো নিচু করল। ম্যাডাম তখন নরম গলায় বললেন, “রাশা, আমি জানি তোমার আবু-আম্মুর মাঝে ডিভোর্স হয়ে গেছে। আমি জানি তোমাদের বয়সী ছেলেমেয়ের বাবা-মায়ের যখন ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তখন তোমরা সেটা মেনে নিতে পারো না। ক্রাইসিস তৈরি হয়। পুরো ফ্যামিলির ওপর খুব চাপ সৃষ্টি করে। তোমারও নিশ্চয়ই করেছে। তোমার এই চাপ সহ্য করা শিখতে হবে। আজকাল এটা খুবই কমন ব্যাপার। ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ডে সিক্সটি পার্সেন্ট ডিভোর্স, আমাদের দেশে স্ট্যাটিস্টিক্স নাই, নিলে দেখবে অনেক–হয়তো ফরটি বা ফিফটি পার্সেন্টের কাছাকাছি। কাজেই তোমাকে ব্যাপারটা মেনে নিতে হবে।”
রাশা এবারে কথা বলল, “ম্যাডাম আমি সেটা মেনে নিয়েছিলাম।”
“তাহলে?”
“অন্য কিছু হচ্ছে ম্যাডাম।”
জাহানারা ম্যাডাম এবারে একটু শঙ্কিত গলায় বললেন, “অন্য কী হচ্ছে?”
রাশা বলবে কিনা বুঝতে পারছিল না, অনেক দিন সে কারো সাথে মন খুলে কিছু বলতে পারে না, আজকে তার ম্যাডামের নরম গলায় কথা শুনে সে একটু ভেঙে পড়ল। কোনোমতে চোখের পানি আটকিয়ে বলল, “ম্যাডাম, আমার আম্মু আমাকে আর সহ্য করতে পারছে না।”
ম্যাডাম চোখ কপালে তুলে বললেন, “কী বলছ! তোমার আম্মু তোমাকে আর সহ্য করতে পারছেন না! তোমাকে সহ্য করতে পারবেন না কেন? তুমি কী করেছ?”
“আম্মুর মনে হয় কাউকে পছন্দ হয়েছে। মনে হয় আবার বিয়ে করতে চান।”
এবারে কথা বলার আগে ম্যাডাম খানিকক্ষণ চিন্তা করলেন, তারপর বললেন, “দেখো রাশা, এটা খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। তোমার মায়ের এত কম বয়স, বাকি জীবনটা কি একা একা থাকবেন? কাজেই তোমার এটাও মেনে নিতে হবে। আসলে দেখবে ব্যাপারটা তোমার জন্যে ভালোই হবে। তুমি তোমার বাবার জায়গায় একজনকে পাবে, বাবা-মা মেয়ে সবাই মিলে পুরো একটা পরিবার হবে–অনেক মজা হবে তখন।”
রাশা মাথা নাড়ল, বলল, “না ম্যাডাম। আমি সেটা বলছি না।”
“তুমি কী বলছ?”
“আমার জন্যে আম্মু বিয়ে করতে পারছে না। আমি হচ্ছি ঝামেলা। আমাকে আম্মু কেমন করে সরিয়ে দিতে পারে সেটা চিন্তা করছে।”
জাহানারা ম্যাডাম থতমত খেয়ে গেলেন, একটু ইতস্তত করে বললেন, “ছিঃ ছিঃ রাশা, এটা তুমি কী বলছ! একজন মা কখনো তার বাচ্চাকে সরিয়ে দেবার কথা ভাবতে পারে না।”
রাশা কোনো কথা বলল না, শুধু একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলল।
ম্যাডাম বললেন, “পৃথিবীটা টিকে আছে মায়েদের জন্যে। একটা মা তার বাচ্চাদের কখনো ছেড়ে যায় না। বুঝেছ?”
রাশা এবারেও কোনো কথা বলল না। ম্যাডাম বললেন, “আমারও দুইটা বাচ্চা আছে–আমিও একজন মা। আমি জানি।”
রাশা কোনো উত্তর দিল না। ম্যাডাম বললেন, “তুমি এসব নিয়ে চিন্তা করো না। দেখবে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। তোমার নূতন করে একটা ফ্যামিলি হবে–কমপ্লিট ফ্যামিলি। বুঝেছ?”
রাশা মাথা নেড়ে জানাল যে সে বুঝেছে। যখন সে চলে যাচ্ছিল তখন জাহানারা ম্যাডাম ডেকে বললেন, “শোনো রাশা। তোমার যখন কিছু দরকার হয়, কোনো কিছু নিয়ে কথা বলতে হয় তখনই তুমি আমার কাছে চলে আসবে। ঠিক আছে?”
রাশা আবার মাখী নাড়ল।
.
যদিও জাহানারা ম্যাডাম রাশাকে বলেছিলেন যে একজন মা কখনোই তার বাচ্চাকে ফেলে দিয়ে চলে যায় না, কিন্তু দেখা গেল রাশার সন্দেহটাই ঠিক। একদিন রাত্রিবেলা রাশা যখন তার কম্পিউটারে কাজ করছে, তখন আম্মু এসে বললেন, “রাশা, কী করছিস মা?”
আজকাল আম্মু কখনোই এই সুরে নরম গলায় কথা বলেন না, তাই রাশা ভেতরে ভেতরে চমকে উঠলেও বাইরে সেটা বুঝতে দিল না। বলল, “ইন্টারনেটে একটা জিনিস দেখার চেষ্টা করছিলাম। নেটটা এত স্লো-”